[english_date] | [bangla_day]

বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন হযরত মওলানা আবদুল মজিদ মাষ্টারের ২৩ তম মৃত্যু বার্ষিকী

রুশনি মোবারক, পটিয়া প্রতিনিধি – বরেণ্য আলেমে দ্বীন, পটিয়ার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্টান হযরত শাহচান্দ আউলিয়া (র.) কামিল মাদ্রাসার অন্যতম প্রতিষ্টাতা হযরত মওলানা আবদুল মজিদ মাষ্টার ১৫ নভেম্বর ২০২০ ইং, ২৩ তম মৃত্যু বার্ষিকী, এই ওফাত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছরের ন্যায় খতমে কোরান ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে, পটিয়া আদালত জামে মসজিদে আসরের নামাজের পর খতমে কোরান ও মুনাজাত পরিচালনা করেন অত্র মসজিদের সম্মানিত হাফেজ মুহাম্মদ নুরুল আবছার। ইসলামী সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ, বিদয়াত ও শিরকমুক্ত সমাজ গঠন, আত্মশুদ্ধি ও কোরান শিক্ষার উন্নয়নে তার অসামান্য অবদান সোনালি অক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি আগাগোড়া ছিলেন জ্ঞান গবেষক, হাদিসের ওস্তাদ ও আধ্যাত্মিক রাহবার। তিনি হযরত শাহচান্দ আউলিয়া (র.) মাদ্রাসা প্রতিষ্টা হওয়ার পর সেখানে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন৷ ৮৫ বছর জীবন ইলমে দ্বীনের খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে তার ভক্ত ও গুণগ্রাহী। তার মধ্যে অন্যতম কুমিল্লা নিবাসী সড়ক ও জনপদ বিভাগের প্রকৌশলী জনাব বাহারুল হক , তিনি তাকে পিতার উর্ধে স্থানে রেখেছিলেন, সম্মান আন্তরিকতা, শ্রদ্ধা, ভালোবাসায় সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন সব সময় , তিনিও খুবই স্নেহ ও ভালোবাসতেন তাকে। তার নমুনার নিদর্শন এখনো বিরাজমান নিজের বড় নাতনির নামের সাথে মিল রেখে নাম রাখেন – রাজিয়া সুলতানা সিমি, সুলতানা রাজিয়া এ্যানি। মানুষ মরণশীল, প্রতিটি মানুষই মারা যাবে সেটাই বাস্তবতা, রেখে যাবে তার সুন্দর সৎ কর্ম, আর তাতেই আজীবন স্বরন করে পরম শ্রদ্ধায়। ৮৫ বছরের জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পঠন পাঠন, লেখালেখি, জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞান বিতরণ, কোরানের ক্বারী ও শ্রুতি মধুর ভাবে তেলওয়াত, মানুষের অহরহ উপকার করা, গভীর রাত অব্দি তাহাজ্জুদ ও বিভিন্ন দেশ, মাজার, দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ, তার মধ্যে ভারতেই ভ্রমন করেছে ৪৪ বার। হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতির (র.) মাজার জেয়ারতের টানে বছরে ২/৩ বারও চলে যেতেন সুদূর ভারতে। বাংলাদেশের প্রায় সকল জেলার কামেল হক্কানি আউলিয়ার মাজারে জেয়ারত করার সৌভাগ্য উনার অনেক বার হয়েছে। তিনি ছিলেন সাদাসিধে, আড়ম্বরবর্জিত, সহজ-সরল, এক দরবেশ, বুজুর্গ । সৌজন্যবোধের প্রাবল্য ও শান্ত সমাহিত মন মেজাজের কারণে তিনি মানুষকে সহজে বিশ্বাস করতেন। তাকেও যারা বিশ্বাস ভক্তি শ্রদ্ধা করতো সবাই আজ যার যার স্থানে ভালোভাবেই প্রতিষ্টিত জীবন যাপন করছে। উনার সাথে মিথ্যা, চল-চাতুরী, সরলতার সুযোগে বিভিন্ন ভাবে ঠকিয়ে, কথার বরখেলাপ করে, মনে আঘাত দিয়েছে তারা অনেকেই আজ অতল গহ্বরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উনার একমাত্র কন্যা, জামাতা, নাতি নাতনী সহ উনার আশেক ভক্তদের জন্য তিনি সব সময়ই দোয়া করেছেন , তারা সব সময় সামাজিক ভাবে সম্মানিত উচ্চস্থানে থাকবে, কেউ কখনো অনিষ্ট করতে পারবেনা, যদি কেউ হিংসা ও লোভের বশবর্তী হয়ে অনিষ্ট করতে চাই তবে তাদের চরম পতন অনিবার্য, ধ্বংস হবে খুবিই করুন ভাবে। মহান বুজুর্গ এই ব্যাক্তির কবরে কোন নাম ফলক নাই তবুও মানুষ বিভিন্ন ভাবে খোঁজ নিয়ে দূর দূরান্ত থেকে এসে জেয়ারত দোয়া মোনাজাত করে প্রতিনিয়ত। তেমনি একজন ভক্ত মোহাম্মদ ছোবাহান, তিনি আগে উনার রিক্সা চালাতেন এখন সন্তানরা সবাই প্রতিষ্টিত, তার কাছে হুজুর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন – অনেক বড় মাপের একজন বুজুর্গ তিনি এইখানে সকল কবরবাসী সম্মানিত করেছেন উনি শায়িত হয়ে, আমার কিছুই ছিলো না দিন এনে দিন খেতাম, উনার দোয়ায় আমি সন্তানদের নিয়ে সুখে আছি। উনি জীবত অবস্থায় যাকে যা বলেছেন তা হয়েছে তার অনেক অলৌকিক ঘটনার স্বাক্ষী আমি নিজে, উনার অলৌকিক ক্ষমতার নিদর্শন বিরাজমান, যা কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। পটিয়া আদালত জামে মসজিদের কবরস্থানে স্ত্রী রশিদা খাতুনের পাশেই চীর নিদ্রায় শুয়ে আছেন বুজুর্গ হযরত মওলানা আবদুল মজিদ মাষ্টার। মূলত তিনি ছিলেন অন্তর্মুখী জ্ঞানগবেষক,আধ্যত্মিক নীরব সাধক ও প্রচারবিমুখ এক মহান বুজুর্গ। বিভিন্ন কিতাব অধ্যয়ন, জিকির আজকার, অজিফা পাঠ, নফল নামাজ ও নফল রোজা, মসজিদে ফরজ ৩০ রোজা এহতেকাফ পালন, তাহাজ্জুদ নামাজ, বিভিন্ন মাজারে নিয়মিত যাতায়াত ও জেয়ারত করা ছিল উনার দৈনন্দিনের আমল। ব্যক্তিগত জীবনে হযরত মওলানা আবদুল মজিদ মাষ্টার বিবাহ করেন সূচক্রদন্ডী মহল্লার বাড়ী নিবাসী মরহুম নুর আহমদ এর তৃতীয় কন্যা রশিদা খাতুন ‘কে, তাদের একমাত্র কন্যা রাবেয়া খাতুন , জামাতা আলহাজ্ব কামাল আহমদ। হযরত মওলানা আবদুল মজিদ মাষ্টার – রশিদা খাতুন দম্পতির একমাত্র কন্যা রাবেয়া খাতুনের তিন পুত্র ও দুই কন্যা রয়েছে তারা সবাই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্টিত। বড় কন্যা – সুলতানা রাজিয়া এ্যানি -স্নাতকোত্তর পাশ, স্বামী নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্তাপক – মীর গ্রুপ, চট্টগ্রাম কর্পোরেট অফিসে কর্মরত, তাদের রয়েছে দুই সন্তান মুহাম্মদ আজমাইন ইনকিয়াদ জিদান ও আজমীরি নানজীবা জেনিলিয়া। বড় ছেলে – মুহাম্মদ রুশনী মোবারক – স্নাতকোত্তর ও এলএলবি শেষ করে বর্তমানে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত আছেন, স্ত্রী জিন্নাতুন নিসা , ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি: কর্মরত। মেঝ ছেলে – মুহাম্মদ হুসনী মোবারক, ব্যবসা করেন। ছোট মেয়ে – শাহিদা আরবী আইরিন – স্নাতক (সম্মান), স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক লি: কর্মরত আছেন, স্বামী- এহসানুল হক বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে কর্মরত আছেন। তাদের রয়েছে একটি সন্তান মুহাম্মদ আমিমুল এহসান জাওয়াদ। ছোট ছেলে – মুহাম্মদ রাফসান জানী, এলএলবি (সম্মান), এলএলএম (ঢাকা) সম্পন্ন করে বর্তমানে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিঃ কর্মরত আছেন, স্ত্রী তানজিনা হোসেন, স্নাতক (সম্মান) শেষ করে বর্তমানে স্নাতকোত্তর অধ্যায়নে রয়েছে । চট্টগ্রামকে বলা হয় ১২ আউলিয়ার পুণ্যভূমি। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য সুদূর আরব ও অন্যান্য দেশ থেকে একাধিক সুফি-সাধক, পীর-আউলিয়া, ফকির-দরবেশ আসেন চট্টগ্রামে। কেউ কেউ কিছুকাল অবস্থান করে ফিরে যান নিজের জন্মভূমিতে। অনেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থেকে যান বন্দর নগরী চট্টগ্রাম ।

ইসলাম প্রচার করতে আসা বিখ্যাত সব সুফি ও আউলিয়ার মাজারে সব সময় যাতায়াত ও জেয়ারত করা ছিলো বুজুর্গ হযরত মওলানা আবদুল মজিদ মাষ্টারের প্রাত্যহিক ছিল

কাজ। বিভিন্ন সময় তিনি তার ডাইরিতে আউলিয়াদের এই দেশে আগমন ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে লিখে রেখেছেন –

হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি-সাধকের একজন হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.)। তাঁর জন্ম ইরানের বোস্তাম শহরে। তিনি ৮০৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতার দেওয়া নাম ছিল আবু ইয়াজিদ। বোস্তাম শহরের অধিবাসী হওয়ায় নামের শেষে বোস্তামী বসানো হয়। বাবার নাম অনুসারে তায়ফুর আবু ইয়াজিদ আল বোস্তামী উল্লেখ করেছেন ইতিহাসবিদগণ।আবার অনেকে সুলতান উল আরেফিন নামে আখ্যা দিয়েছেন তাঁকে। জানা যায়, তিনি অত্যন্ত মাতৃভক্ত ছিলেন। অনেকে ধারণা করেন, মাতৃভক্তের কারণে বায়েজিদ বোস্তামী ইসলামের সাধক ও প্রচারক হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তাঁর মাতৃভক্তি সম্পর্কে কিছু গল্প প্রচলিত আছে। এক গভীর রাতে মা ঘুম ভেঙে পানি খেতে চেয়েছিলেন বায়েজিদের কাছে। তখন ঘরে পানি ছিল না। দূরের ঝরনা থেকে পানি আনতে বের হন তিনি। পানি নিয়ে ঘরে ফেরার পর তিনি দেখেন মা ঘুমিয়ে পড়েছেন। মাকে ঘুম থেকে না ডেকে মাথার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন সারা রাত। মায়ের ঘুম ভাঙার পর জেগে দেখেন ছেলে পানির গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে মা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তখন তিনি মনভরে দোয়া করেন ছেলের জন্য। মাতৃভক্তির এই অনন্য উদাহরণ এখনো মানুষের মুখে মুখে। বায়েজিদ বোস্তামী পুরো জীবনেই ইসলাম প্রচার ও সৃষ্টিকর্তার প্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি-‘আমি একবার স্বপ্নে দেখলাম, আল্লাহকে আমি জিজ্ঞাসা করছি, তাঁকে পাওয়ার পথ কী? তিনি বললেন, নিজেকে ত্যাগ কর, দেখবে পৌঁছে গিয়েছ।’ শৈববকাল থেকেই তিনি আল্লাহর ইবাদত ও মায়ের খেদমতে সময় কাটাতেন। তার পিতা-মাতাও জ্ঞানার্জনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় তাঁর জ্ঞান শিক্ষার জন্য কয়েকজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে পিতার অকাল মৃত্যুর পর মা বায়েজিদ বোস্তামীর শিক্ষা কার্যক্রম সার্বিক তত্ত্বাবধান করেন। তিনি ১১৩ জন শিক্ষকের অধীনে জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর শিক্ষকের মধ্যে ছিলেন ইরানের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুফি সাধক হযরত ইমাম সাদিক (রহ.) ও হযরত শফিক বলখি (রহ.)। বায়েজিদ বোস্তামী ঠিক কত সালে চট্টগ্রামে এসেছিলেন তার কোনো প্রামাণিক তথ্য নেই। তবে মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতান তাঁর কবিতায় এক সুফি-সাধকের কথা উল্লেখ করেছেন। বায়েজিদ বোস্তামীকে যেহেতু সুলতান উল আরেফিন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয় তাই শাহ সুলতান হিসেবে সুলতান উল আরেফিনকে ধরে নেওয়া হয়। ইসলাম প্রচার করতে বায়েজিদ বোস্তামী চট্টগ্রামে এসে মানব সেবায় সম্পৃক্ত হন। তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন। আর চলে যাওয়ার আগে তিনি অনুসারী ও ভক্তকুলের অনুরোধে কনিষ্ঠ আঙুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত মাটিতে ফেলেন। পরবর্তীতে রক্তের ফোঁটা পড়া ওই জায়গায় ভক্তকুল গড়ে তোলে মাজার। ৮৭৭ সালে ১৩১ বছর বয়সে মহান এই সুফি বায়েজিদ বোস্তামী সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দেন। ইরানের বোস্তাম শহরেই তাঁকে দাফন করা হয়।জনশ্রুতি আছে, হযরত বায়েজিদ বোস্তামী নিজেই এখানে মাজার তৈরির নির্দেশ দেন।১৮৩১ সালে হযরত বায়েজিদ বোস্তামী এলাকায় একটি দেয়াল ঘেরা আঙিনা আবিষ্কার করা হয়। এরপর থেকে তা বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার হিসেবে জিয়ারত করে আসছেন ভক্ত-অনুসারীরা। মাজারের পাদদেশে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর। যাতে রয়েছে বিরল প্রজাতির কাছিম। যাকে ভক্ত-অনুসারীরা মাজারি ও গজারি নামেই ডাকেন। এখনো প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর মানুষ বায়েজিদ বোস্তামীর মাজার দর্শনে আসেন। তারা প্রার্থনা করেন।

হযরত শাহ আমানত (রহ.) –

হযরত শাহ আমানত (রহ.) ছিলেন ইরাকের অধিবাসী। ১৬৮০ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন বলে ধারণা করা হয়। তাঁর পিতার নাম হজরত নিয়ামত শাহ (রহ.)। বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানীর বংশধর ছিলেন হযরত শাহ আমানত (রহ)। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন বংশ পরম্পরায় সুফি, পীর-আউলিয়া। শিশুকাল থেকেই তিনি সৃষ্টিকর্তার সাধনায় মশগুল ছিলেন। অল্প বয়সে ইসলাম প্রচার ও কঠিন সাধনায় মনোনিবেশ করেন তিনি। সংসারের মায়া ত্যাগ করে আধ্যাত্মিক জ্ঞানার্জনের জন্য ভারতবর্ষে আসেন। কিছু দিন বসবাস করেন বিহারে। এরপর প্রখ্যাত পীর হজরত শহীদ (রহ.)-এর সান্নিধ্য পেতে চলে যান কাশ্মীর। সেখানে হজরত শহীদ (রহ.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দীর্ঘ এক যুগ তাঁর সান্নিধ্যে থেকে অর্জন করেন আধ্যাত্মিক জ্ঞান। গুরুর নির্দেশে বেরিয়ে পড়েন ইসলাম প্রচারে। ধারণা করা হয়, ১৭৯৩ সালে আসেন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। তিনি নিজের পরিচয় গোপন রেখে চট্টগ্রাম আদালতে চাকরি নেন পাখা টানার। দিনের বেলায় তিনি চাকরি শেষে রাতে লালদীঘির পূর্বপাড়ে ছোট্ট কুটিরে আল্লাহর ধ্যানে মশগুল থাকতেন। তাঁর জীবনযাপন ছিল সাধারণ। আচার-আচরণ ছিল নম্র। তিনি অসহায় মানুষকে নানান সহায়তা করতেন। অচিরেই তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে এলাকাজুড়ে। স্থানীয় লোকজন তাঁকে ‘মিয়া সাহেব’ বলে সম্বোধন করতেন। অল্প সময়ে অসংখ্য ভক্ত ও অনুরাগী তৈরি হয় তাঁর। নিজের অনুসারীদের ন্যায়ের পথে চলা, হালাল আয়, অধিক ইবাদত ও সৎ উপদেশ দিতেন। এক সময় ভক্তকুলের মাঝে প্রকাশ পেতে থাকে তাঁর আধ্যাত্মিক শক্তি। আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পাওয়ার পর তিনি চট্টগ্রাম আদালতে আর চাকরি করেননি। চাকরি ছেড়ে ইসলাম প্রচার এবং মানবকল্যাণে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেন। হজরত শাহ আমানত (রহ.) সব সময় ইহরামের কাপড়ের মতো সাদা কাপড় পরতেন। ইসলামের এই মহান সাধক হজরত শাহ আমানত (রহ.) ১৮০৬ সালে ১২৫ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তাঁকে লালদীঘির পূর্বপাড়ে বর্তমান খানকাহ শরিফে দাফন করা হয়। তাঁর খানকায় দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর মানুষ আসেন। তারা দোয়া পাঠ করেন। দান করেন মুক্তহস্তে। প্রতি বছর তাঁর খানকায় ওরশ হয়। সেখানে দান-খয়রাতের পাশাপাশি ভক্তকুল আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন।

হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী (রহ.) –
চট্টগ্রামের প্রখ্যাত মাইজভান্ডার দরবার শরিফের প্রতিষ্ঠাতা হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারী। তিনি মাইজভান্ডার তরিকারও প্রতিষ্ঠাতা।

তাঁর পূর্বপুরুষ সৈয়দ হামিদ উদ্দিন গৌড়ি ইসলাম প্রচার করতে ১৫৭৫ সালে চট্টগ্রামে এসে পটিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। তাঁর পুত্র সৈয়দ আবদুল কাদের ফটিকছড়ি থানার আজিম নগরে ইমামতির দায়িত্ব নিয়ে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর প্রপৌত্র মাওলানা সৈয়দ মতি উল্লাহর ঔরসে ১৮২৬ সালে জন্ম হয় সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারীর। শিশুকালে পিতা ও গ্রামীণ মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। এক সময় উচ্চ শিক্ষার জন্য তাঁকে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পাঠানো হয়।কৃতিত্বের সঙ্গে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করে যশোর জেলার কাজী (বিচারক) হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু কিছুতেই তাতে মন বসছিল না তাঁর। কাজীর চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে যোগ দেন করেন শিক্ষকতায়। যোগদান করেন কলকাতার মুন্সি বুয়ালি মাদ্রাসায়। এ সময় মুন্সেফি অধ্যায়নও শুরু করেন। সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভান্ডারীর পীর ছিলেন বড় পীর আবদুল কাদের জিলানীর বংশধর শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরী লাহোরি। পীরের তরিকতি বড় ভাই হজরত শাহ সৈয়দ দেলাওর আলীর কাছেও বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরি লাহোরির কাছে বাইয়াত গ্রহণ করার পর শুরু করেন আধ্যাত্মিক সাধনা। কিছুকাল কঠোর সাধনার পর ১৮৫৭ সালে শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মুহাম্মদ ছালেহ আল কাদেরি লাহোরির নির্দেশে নিজ গ্রাম ফটিকছড়িতে ফিরে আসেন।গ্রামের বাড়িতে এসেই শুরু করেন আধ্যাত্মিক চর্চা। অল্প সময়ের মধ্যে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে খ্যাতি। স্থানীয় লোকজন দোয়া নিতে আসতে শুরু করেন তাঁর সান্নিধ্যে এসে।একে একে আশপাশ মহকুমা ও জেলায় ছড়িয়ে পড়ে হজরত সৈয়দ আহমদ মাইজভান্ডারীর নাম। হজরত সৈয়দ আহমদ মাইজভান্ডারী শুধু আধ্যত্মিক জগতের অন্যতম সম্রাট নন, তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি স্বতন্ত্র তরিকা। কাদেরিয়া তরিকা অনুবর্তনে আলাদা একটি তরিকা প্রতিষ্ঠিত করে নাম দেন মাইজভান্ডারী তরিকা। মূলত কোরআন ও হাদিসভিত্তিক ইসলামের মৌলিক ভাবাদর্শের অনুসরণে একটি তরিকা মাইজভান্ডারী তরিকা।অন্যান্য তরিকার আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যগুলো একত্র করা হয়েছে মাইজভান্ডারী তরিকায়। মাইজভান্ডারী তরিকা কাদেরিয়া সিলসিলার তরিকার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই তরিকায় বাইয়াত প্রদানের সময় কাদেরিয়া তরিকা অনুসরণ করা হয়। ১৯০৬ সালে সৃষ্টিকর্তার ডাকে সাড়া দেন হযরত সৈয়দ আহমদ মাইজভান্ডারী। প্রতি বছরের ১০ মাঘ হজরত সৈয়দ আহমদ মাইজভান্ডারীর ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। ওই ওরসে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার ভক্ত হাজির হন। এ ছাড়া প্রতিদিনই বহু ভক্তের পদচারণায় মুখরিত থাকে মাইজভান্ডার দরবার প্রাঙ্গণ।

হযরত শাহ মোহছেন (রহ.) –

আরব দেশ থেকে ইসলাম প্রচার করতে আসা বিখ্যাত সুফি-সাধকের একজন হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ).। আধ্যাত্মিক জগতের এই খ্যাতিমান ব্যক্তির জন্ম ইয়েমেনের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ইসলামী মনীষীর কাছ থেকে পান্ডিত্ব লাভ করে মনোনিবেশ করেন ইসলাম প্রচারে। শিক্ষা, শিল্প এবং সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল ভারতের গৌড় রাজ্য। মোহছেন আউলিয়া গৌড় রাজ্যে কিছুদিন অবস্থান করার পর স্থির করেন পূর্ববঙ্গে আসার। তিনি পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ বাংলাদেশে এসেছেন তা জানা না গেলেও প্রখ্যাত সুফি হযরত বদর শাহ (রহ.)-এর সঙ্গে তিনি চট্টগ্রাম আসেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।পানি পথেই তিনি চট্টগ্রামে আসেন। তিনি একটি পাথরকে নৌকা বানিয়ে পানি পথে ভারত থেকে চট্টগ্রাম আসেন। বন্দরনগরীতে এসে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত দেয়াং পাহাড়ে আস্তানা গড়েন। সেখানে শুরু করেন ইসলাম প্রচার। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। বিভিন্ন বই-পুস্তকে উল্লেখ রয়েছে হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়ার নানান অলৌকিক ঘটনা। এর মধ্যে একটি হচ্ছে- কোনো একদিন গ্রামের নির্জন মাঠে এক বোবা ছেলে গরু-ছাগল দেখাশোনা করছিল। এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন সুফি-সাধক মোহছেন আউলিয়া। ওই রাখাল বালকটিকে দেখেই কিছু জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু বালকটি বোবা হওয়ায় কোনো উত্তর দিতে পারেনি। মোহছেন আউলিয়া এ সময় বালকটির মুখের ওপর হাত রাখেন। সঙ্গে সঙ্গে রাখাল বালকটি কথা বলতে শুরু করে। তিনি তখন রাখাল বালকটিকে বললেন তার পিতা-মাতাকে ডেকে আনতে। সে বাড়িতে গিয়ে যখন পিতা-মাতার সঙ্গে কথা বলা শুরু করল, তখন এলাকার সবাই আশ্চর্য হয়ে যায়। তার এ অলৌকিক ক্ষমতা দেখে দলে দলে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার ভক্তকুল তৈরি হয় হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়া (রহ.)-এর। ১৫৬৫ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তারপর তাকে আনোয়ারা উপজেলার ঝিউরী গ্রামে সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু শঙ্খ নদের ভাঙনের কবলে পড়লে সেই সমাধি পরে স্থানান্তর করা হয় আনোয়ারার বটতলীতে। বর্তমানে ওখানে রয়েছে হজরত শাহ মোহছেন আউলিয়ার মাজার। প্রতিদিনই হাজার হাজার ভক্তের আগমন ঘটে মাজারে। এ ছাড়া প্রতি বছর আষাঢ় মাসের ৬ তারিখ বার্ষিক ওরশ অনুষ্ঠিত হয়। ওরশে লাখো ভক্তের আগমন হয় মাজার প্রাঙ্গণ। হযরত মওলানা আবদুল মজিদ মাষ্টার, শাহ মোহছেন আউলিয়ার একজন একনিষ্ট ভক্ত ও খাদেম ছিলেন।

শেখ ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকর (রহ.)।তিনি বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও ফরিদপুরে ইসলাম প্রচার করেন। চট্টগ্রামে শেখ ফরিদউদ্দিন চশমা নামেই পরিচিত। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের পাঠপাটান জেলায় তার মাজার শরিফ রয়েছে। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন শাহ বদর আউলিয়া। ১২ আউলিয়ার মধ্যে বদর আউলিয়াকেই প্রধান হিসেবে সম্মান দেখানো হয়। চট্টগ্রামের বকশিরহাটের কাছে বদরপট্টি বা বদরপটি গলিতে তাঁর মাজার অবস্থিত। এ ছাড়া উনার পীর সাহেব হযরত নুরুল হক শাহ (রহ.) , হযরত গরিব উল্লাহ শাহ (রহ.), হজরত মোল্লা মিছকিন শাহ (রহ), হজরত বদনা শাহ (রহ.) প্রকাশ শফি শাহ (রহ), হজরত আনার উল্লাহ শাহজী (রহ), হজরত ইয়াসিন আউলিয়া (রহ.), হজরত শাহা চান্দ আউলিয়া (রহ.), জিয়াউল হক মাইজভা-ারী (রহ.), হজরত শাহজাহান শাহ (রহ.), হজরত আজিজুল হক আল কাদেরী (রহ.), হজরত আমির শাহ (রহ.), আমিরুজ্জামান মাইজভান্ডারী (রহ.), হজরত টাক শাহ (রহ.), হজরত আকবর শাহ (রহ.), হজরত নজির শাহ (রহ.), হজরত জঙ্গি শাহ (রহ.), হজরত শাহ আবদুল বাসেত (রহ.), হজরত শাহ চাঁন্দ আউলিয়া (রহ.),, হযরত কাতাল পীর (রহ.), হযরত খলিলুর রহমান শাহ (রহ.), হযরত আবদুল আজিজ পাঠুনটুলি (রহ.), হযরত মুকবুল শাহ (রহ.), হযরত কানু শাহ, হযরত আবুল খায়ের সুলতানপুরী সহ অসংখ্য পীর আউলিয়ার মাজারে নিয়মিত যাতায়াত জেয়ারত করাই ছিলো হযরত মওলানা আবদুল মজিদ মাষ্টারের অন্যতম ধ্যান জ্ঞান।

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

পাঠক প্রিয়