[english_date] | [bangla_day]

এসো হে বৈশাখ: শুভ নববর্ষ ১৪২৮

চিটাগাং মেইল ডেস্ক:  বৈশাখ রুদ্র আবেগে এনেছে নতুন ঋতু গ্রীষ্মের জাগরণ। এনেছে নতুন বছর, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালে পর পর দুটি নববর্ষের সকল আয়োজন পুঞ্জিভূত সামাজিক দূরত্বের ঘেরাটোপে। স্বাস্থ্যবিধির কঠোর প্রয়োগ চারদিকে। মুক্ত ও বাধাহীন বৈশাখের মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশ ও বিশ্বের নানা স্থানে চলছে লকডাউন।

বৈশাখের কথায়, বাংলা নববর্ষের স্পর্শে সবার মনের গহীনের জাগ্রত হয় এক অনাদি বাউল, যে বাউলটি শিল্পী প্রতীক চৌধুরীর গানের মতো ঘরে ফেরার, নিজস্ব পরিচিতি ও সাংস্কৃতিক আইডেন্টিটির কাছে ফিরে আসার ডাক দেয়। মায়াবী কণ্ঠের দোলায় বলে: ‘দূরে বহু দূরে, গাইছে বাউল একতারায়, মনপাখি তুই ঘরছাড়া, এবার ঘরে আয়’।

বৈশাখ আসলে ঘরে ফেরার ডাক। বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম নিজস্বতায় অবগাহনের প্রেরণা। নিজের আত্মপরিচিতি ও আত্মআবিষ্কারের প্রতীতি ও প্রত্যয়ের নাম বৈশাখ।

বাঙালির সাংস্কৃতিক আইকন রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১ খ্রি.) জন্ম বৈশাখ মাসে। বৈশাখের প্রতি তার সুগভীর অনুরাগ। তিনি বৈশাখকে দেখেছেন সৃষ্টির উন্মাদনায়, ধ্বংসের তাণ্ডবে। বলেছেন-

‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ

তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক – – –

যাক পুরাতন স্মৃতি যাক ভুলে যাওয়া গীতি

অশ্রু বাষ্প সুদূরে মিলাক।’

রবীন্দ্রনাথের রুদ্র বৈশাখ কখনো ভিন্ন মাত্রায় প্রতিফলিত –

‘হৈ ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ,

ধুলায় ধূসর রুক্ষ উড্ডীন পিঙ্গল জটাজাল,

তপঃক্লিষ্ট তপ্ত তনু, মুখে তুলি বিষাণ ভয়াল

কারে দাও ডাক-

হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ?’

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬ খ্রি.)-এর জন্ম বৈশাখ মাসে না হলেও তিনি স্বভাবে, আচরণে কাব্যভাবে বৈশাখের মতো রুদ্র, প্রকৃতির মতো অশান্ত, সতত বিদ্রোহী এবং ‘চির উন্নত শির’-

‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কালবৈশাখীর ঝড়

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

তোরা সব জয়ধ্বনি কর

ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর

প্রলয় নূতন সৃজন বেদন

আসছে নবীন জীবন ধারা অসুন্দরে করতে ছেদন

তাই যে এমন কেশে-বেশে

মধুর হেসে

ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির সুন্দর।’

চিরায়ত বৈশাখের রূপ, রস, আবহ তথা যাবতীয় অনুষঙ্গ শাশ্বত বাংলার ও বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে, ব্যক্তিগত চর্যায়, সামাজিক গতিশালতায় এবং ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারে এক অবিভাজ্য অংশ। বৈশাখ আর বাঙালি যেন একাকার সত্তা। নগর ও গ্রামীন জীবনে বৈশাখ তথা বাংলা নববর্ষের দ্যোতনা বাঙালি জীবনে ঋদ্ধিমান আলোকমালায় দীপ্ত ও উৎসবমুখর।

কিন্তু করোনাকালে সকল আয়োজন স্থগিত। তথাপি অন্তরে নিত্য আবাহন। ‘মেলায় যাইরে’ বলে সপ্রাণ ছুটে যায় বৈশাখী মেলায়, নাগরদোলায়, লোকায়ত সংস্কৃতির আদিঅন্তহীন দিগন্তে। সেই বৈশাখী প্রাণাবেগ ও গতিই এবার ঘরে ঘরে, সঙ্গরোধে, গৃহবন্দিত্বে, নবতর বিন্যাসে আলোকোজ্জ্বল করবে প্রতিটি গৃহকোণ। মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বার্তায় জাগাবে প্রত্যেক বাঙালিকে। প্রীতি, শুভেচ্ছা ও প্রেমের শক্তিতে সর্বব্যাপী মারি, অন্ধকার, অকল্যাণ, অশুভর মূর্তিমান বিভীষিকার বিরুদ্ধে জীবনজয়ী কণ্ঠে উচ্চারিত হবে বিশ্বাসী মানব প্রজন্মের প্রার্থনাসঙ্গীত, ‘তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে, মলিন মর্ম মুছায়ে। তব, পূণ্য-কিরণ দিয়ে যাক্, মোর মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।’

এক ঐতিহাসিক পরম্পরায় সাংস্কৃতিক মাস বৈশাখ আর কৃচ্ছ্বতার মাস রমজান সূচিত হয়েছে একই দিনে। সৃজন হয়েছে পবিত্র ও কল্যাণকর পটভূমি। বেপথু মানুষ এবার ঘরে তথা নিজের চেতনা ও বিশ্বাসের কাছে এসে আত্মউপলব্ধির কষ্টিপাথরে নিজেকে বিচার-বিশ্লেষণ করে মনুষ্যত্বের মহত্তম পরিচিতিতে ঋদ্ধ হলেই আসবে সার্থকতা, দূর হবে অন্ধ-অন্ধকার ও আবিলতা। জয় হবে মানুষ ও মানবিকতার।

নতুন বছর ১৪২৮ বঙ্গাব্দ প্রতিটি বাঙালির, শুভবাদী মানুষের এবং মানবতার বিজয় সুনিশ্চিত করুক। বিশ্বের প্রতিটি তাপিত, পীড়িত, লাঞ্ছিত, নিগৃহীত, শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের মুখে ফুটিয়ে তুলুক ন্যায্য মানবিক অধিকারের আইনানুগ প্রাপ্তি ও অর্জনের অনাবিল হাসি।

শুভ নববর্ষ সবাইকে।

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

পাঠক প্রিয়