[english_date] | [bangla_day]

মানিকের আদ্যোপান্ত-

ডেক্স রিপোর্ট: বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শাসসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ভারতে পালিয়ে যাবার সময় শুক্রবার রাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি’র হাতে আটক হয়েছেন। সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দনা সীমান্ত এলাকা থেকে তাকে আটক করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে- বিজিবি।

সূত্রে জানা যায়, আটক করার পর তাকে বিজিবি ক্যাম্পে হেফাজতে রেখে কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। পরবর্তীতে তাকে রাত ১২টা নাগাদ ক্যাম্প থেকে থানার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।

সাবেক বিচারপতি মানিককে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ঘটনাস্থলের কাছাকাছি উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নাজিম উদ্দিন। তিনি বলেন, গতরাতে (শুক্রবার) এক ব্যক্তি তাকে টেলিফোন করে জানান যে অপরিচিত একজন লোক বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাচ্ছে। তখন বিষয়টি স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পে জানানোর পরামর্শ দেন তিনি।

সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ২০১৩ সালে নিয়োগ পান বিচারপতি মানিক। তৎপূর্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল করা হয়। তিনি শেখ মুজিব হত্যা মামলার আইনজীবীও ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তাকে হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সে নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে শাসসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিচারপতি হিসেবে পুনর্বহাল হন।

তাকে নিয়ে এতো বিতর্ক কেন?
সম্প্রতি চ্যানেল আইতে একটি টকশোতে গিয়ে উপস্থাপকের সাথে আক্রমনাত্মক আচরণ করে সমালোচিত হন, মানিক।

সাবেক বিচারপতি মানিক যেভাবে আটক হলেন-
ইউপি সদস্য নাজিম উদ্দিন এবং স্থানীয়দের বর্ণনা অনুযায়ী, বিচারপতি মানিক যে স্থান থেকে আটক হয়েছিলেন, ওই জায়গাটায় পাহাড়ি জঙ্গল আছে। ভারতীয় সীমান্তে খাসিয়াদের গ্রাম। বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে আধা কিলোমিটারের মতো এলাকায় জঙ্গল রয়েছে। খাসিয়াদের গ্রাম পার হলেই বড় সড়কের দেখা মেলে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি মানিককে দেখেন। তখন তিনি কলাপাতার ওপর শুয়ে ছিলেন। কিন্তু স্থানীয়রা মানিকের পরিচয় সম্পর্কে জানতেন না। তারা বুঝতে পারেন এই ব্যক্তি স্থানীয় বাসিন্দা নয় এবং তিনি অবৈধভাবে ভারতে যাবার জন্য অপেক্ষা করছেন।

একজন ব্যক্তির পালানোর খবরে বিজিবি সদস্যরা ঘটনা স্থলে যান। সেখানে গিয়ে দেখেন তিনি কলা পাতার ওপরে শুয়ে আছেন।

এরপর তাকে ধরে কিছু প্রশ্ন করেন বিজিবি সদস্যরা। সেইসব জিজ্ঞাসাবাদের কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ভিডিওতে দেখা যায়, একজন বিজিবি সদস্য তাকে জিজ্ঞেস করছে, “আপনার বাড়ি কোথায়?”

উত্তরে তিনি বলেন যে মুন্সিগঞ্জ। এরপর নাম জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “আমার নাম বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক।”

তখনই ওই বিজিবি সদস্যকে বিদ্রুপ করে বলতে শোনা যায়, “বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক? ওই মানিককা… যে কয়দিন আগে চ্যানেল আইতে এক উপস্থাপককে…ই…করছো…”

তখন মানিক নিজেই বলেন, সেই উপস্থাপিকার কাছে তিনি পরে “ক্ষমা” চেয়েছেন।

এরপর এক পর্যায়ে তিনি তার বাবার নাম বলেন- মরহুম আব্দুল হাকিম চৌধুরী।

তার কাছে তখন জানতে চাওয়া হয় যে তিনি কেন ভারতে পালাচ্ছেন? তার উত্তরে তিনি বলেন, “ভয়ে পালাইতেছি…প্রশাসনের ভয়ে।”

ভিডিওতে তাকে আরো বলতে শোনা যায় যে তিনি ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। পালানোর সময় তার সাথে ব্রিটিশ পাসপোর্ট, বাংলাদেশি পাসপোর্ট, টাকা, কিছু ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড ছিল। কিন্তু যাদের সহায়তায় তিনি পালাচ্ছিলেন, তারা তার কাছে থাকা ৬০-৭০ লাখ টাকা নিয়ে নিয়েছে এবং তাকে তারা “সীমান্তের ওপারে নিয়ে মেরেছে” বলেও জানান তিনি।

আটক করার পরে বিজিবি সদস্যরা তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে।

তিনি কি সীমান্ত পার হয়েছিলেন?
সাবেক বিচারপতি মানিকককে যখন আটক করা হয়, তখন তিনি বাংলাদেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তাকে বলতেও শোনা গেছে যে তিনি বাংলাদেশে আসবেন না। মানিক মনে করেছিলেন যে তিনি ভারতের ভেতরে প্রবেশ করেছেন। কিন্তু তিনি প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সীমান্তে শুয়ে আছেন।

এ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেন প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নাজিম উদ্দিন। তিনি জানান, সীমান্ত পার করানোর জন্য মানিককে ওই এলাকার মিকিরপাড়া সড়ক দিয়ে নেয়া হয়েছে। “এটা পাহাড়ি এলাকা, এখানে রাস্তাঘাট নাই, যানবাহন চলাচলের সুযোগ নাই। মাঝেমাঝে শুধু মোটর সাইকেলে করে যাওয়া যায়। তবে তাকে হেঁটে যেতে হয়েছিলো।”

ওই ডনা ক্যাম্পসের পাশেই একটি বাজার আছে। সেই বাজারের “পশ্চিম পাশ থেকে পায়ে হাঁটা রাস্তা দিয়ে ওনাকে নিয়ে গেছে, দূরত্ব এক কিলোমিটার হবে,” যোগ করেন নাজিম উদ্দিন।

“ওনাকে হেঁটে যেতে হয়েছে, তাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো…ওখানে ভারতের পিলার আছে। ভারতের সেই পিলারের পশে নিয়ে ওরা তাকে বলছে, আপনি ভারতে চলে আসছেন। এটা শুনে উনি রেস্ট নিতে চাইলে ওরা তাকে কলাপাতা দিয়ে দিছে। মূলত, উনি বাংলাদেশের মাঝের জায়গায় বিশ্রাম নিচ্ছিলো।”

“পরে স্থানীয় কিছু লোকজন যখন সংবাদ পাইছে, তাদেরকে উনি বলছেন– আমি ভারতে চলে আসছি। বাংলাদেশে যাবো না,” যোগ করেন ওই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য।

মানিক বলছিলেন, তিনি যাদের সাথে গিয়েছেন, তারা তাকে মারধর করেছেন এবং তার সব টাকা-পয়সা নিয়েছেন। কিন্তু ওদের কারো ফোন নম্বর তার কাছে ছিল না। তাদের নামও বলতে পারেননি।

এ প্রসঙ্গে- নাজিম উদ্দিনের ভাষ্য, “মূলত, যারা নিয়ে গেছে, তারা ওনার সামনে বসে একজন আরেকজনকে ভিন্ন নামে ডাকাডাকি করছিলো। তাই নাম মিলছে না।”

মানিককে নিয়ে যত বিতর্ক
ছাত্র বিক্ষোভের সময় বেসকারি টেলিভিশন চ্যানেল আই-এর একটি টকশো গিয়ে এক নারী উপস্থাপকের সাথে আক্রমনাত্মক আচরণ করে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েন মি. মানিক। সেটি ভিডিও ইন্টারনেট-ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ছড়িয়ে পড়ে।

মানিকের বিরুদ্ধে সরকারি বাড়িভাড়া পরিশোধ না করাযর বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী।

নোটিশে বলা হয়, অবসরে যাওয়ার পর এক বছরের বেশি সময় রাজধানীর গুলশানে একটি সরকারি বাড়ি দখলে রেখেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। পরে ২০১৭ সালে তিনি বাড়িটি ছাড়লেও বাড়িভাড়া, গ্যাস ও পানি বিল বাবদ সরকারের পাওনা ১৪ লাখ ১৯ হাজার ২০০ টাকা এখনও পরিশোধ করেননি তিনি।

 

বিচারপতি থাকা অবস্থায় শাসসুদ্দিন মানিককে নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছিল। যে রায়টি কেন্দ্র করে মানিক সমালোচনার কেন্দ্রে আসেন সেটি হচ্ছে, কর্নেল তাহের হত্যা মামলার রায়।

সে রায়ে মানিক কর্নেল তাহেরের বিচারকে ‘ঠান্ডা মাথার খুন’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি জিয়াউর রহমানকে ‘ঠান্ডা মাথার খুনি’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

২০১৫ সালে আপিল বিভাগের বিচারপতি থাকা অবস্থায় শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার সাথে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সিনহা শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে একটি বেঞ্চ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।

এরপর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার অভিশংসন চেয়ে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠিও দিয়েছিলেন। অবসরে যাবার কয়েকদিন আগে তিনি একাজ করেছিলেন।

বিচারপতি থাকা অবস্থায় বিমানের বিজনেস ক্লাসে সিট না পাওয়া নিয়ে মানিক লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছিলেন। ২০১২ সালের শেষের দিকে এই ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার জেরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স-এর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশ জারি করেছিলেন শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।

পরে বিমানের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ চারজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাইকোর্টে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বেঞ্চে গিয়ে নি:শর্ত ক্ষমতা চেয়ে নিষ্কৃতি পান।

চাকরি শেষে বাড়ি না ছেড়েও তিনি আলোচনায় এসেছিলেন।

২০১২ সালে বিচারপতি থাকা অবস্থায় লন্ডনে তিনি হামলার শিকার হয়েছিলেন। এছাড়া ২০১৫ সালে অবসর গ্রহণের পরে আবারো তিনি লন্ডনে হামলার শিকার হন।

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক দ্বৈত নাগরিকত্ব নাগরিকত্ব রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের পাশপাশি ব্রিটেনেরও নাগরিক।

২০১২ সালের জুন মাসে তৎকালীন জাতীয় সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিনিয়র সংসদ সদস্য শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সমালোচনা করেছিলেন। আদালতে বসে মি. মানিক তৎকালীন সংসদের স্পিকার আব্দুল হামিদের (পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি) নজিরবিহীন সমালোচনা করেছিলেন।

এরপর মি. মানিকের সমালোচনা করা হয় সংসদে। মি. মানিককে অপসারণের লক্ষ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার জন্য তাঁরা প্রধান বিচারপতি এবং প্রেসিডেন্টকে তিন দিনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন।

তৎকালীন সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে ‘স্যাডিস্ট’ হিসেবে বর্ণনা করেন।

“তিনি মানুষকে অপমান করতে পছন্দ করেন। যারা স্যাডিস্ট, অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়, আমরা তাদের ঘৃণা করি,” বলেছিলেন তোফায়েল আহমেদ।

তৎকালীন সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সংসদের বলেছিলেন, “শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক তাঁর পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন”

তোফায়ল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছাড়াও শেখ ফজলুল করিম সেলিম ও রাশেদ খান মেনন শামসুদ্দিন চৌধুরীর মানিকের সমালোচনা করেছিলেন।

সংসদে এই সমালোচনার পরেও শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কোন অসুবিধা হয়নি। সংসদের সমালোচনার ছয়মাস পরেই তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে ২০১৩ সালে পদোন্নতি পান।

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

পাঠক প্রিয়