মোহাম্মদ হাসানঃ একটি পতাকা একটি জাতির পরিচয়, গর্ব ও অহংকার। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন পতাকা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। লাল-সবুজ দেখলেই বাঙালি জাতির মাথা নুয়ে আসে। এ এক টুকরো রঙিণ কাপড়কে অর্জণের জন্যই নিস্পাপ শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ অগণিত মুক্তিযোদ্ধার অমূল্য জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে। এই একটুকরো কাপড়, আমার পতাকা, আমাদের কোটি মানুষের মাথা ঊঁচু করে বেঁচে থাকার প্রতীক, আমাদের জাতীয় পতাকা। শিল্পীর কণ্ঠে বাঁজে, ‘আমাদের পতাকা আমাদের মান সত্য, সুন্দর, বিজয় নিশান’।
স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তীর ঊষালগ্নে ভারতের আকাশে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে অন্য রকম বিজয় দিবস পালন করেছেন চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার মঘাদিয়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মাসুদ ও তার ক্যান্সারে আক্রান্ত চার বছর বয়সী শিশু পুত্র মারওয়ান চৌধুরী। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেশপ্রেমিক জনগণের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন পিতা পুত্র।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী থেকে মুক্তি লাভ করে প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। তাই এই দিনটা বাঙালীরা আনন্দ উৎসবের মধ্যদিয়ে উদযাপন করে থাকে। কিন্তু দেশের প্রতি কেমন ভালোবাসা থাকলে ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুপুত্র কে নিয়ে অন্য দেশের মাটিতে নিজের দেশের বিজয়ের উৎসব করা যায়!
চার বছর বয়সী একমাত্র শিশু পুত্র মারওয়ানের হাসি খুশি প্রাণচঞ্চল মাসুদ চৌধুরী দম্পতির ছোট সুখের সংসার । হঠাৎ এক আচমকা ঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেল সব, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো ছোট্ট বাবু ছালেহ মারওয়ান চৌধুরী দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত! ডাক্তার সকল পরীক্ষা নিরিক্ষা করে ভারতে নিয়ে চিকিৎসা করার পরামর্শ দিলেন। এরপর কোভিড-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেই গত অক্টোবর মাসে দ্রুত সময়ের মধ্যে ভারতে নিয়ে চেন্নাইয়ের সিএমসি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পুনরায় ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে কেমোথেরাপি ও অস্ত্রপ্রাচার করতে হবে বলে জানান। বর্তমানে তার কেমোথেরাপি চলছে।
এরই মধ্যে চলে আসে লাল সবুজের বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। পিতা তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মাসুদ এর দেশপ্রেমের অনুপ্রেরণায় ছালেহ মারওয়ান চৌধুরীও বিজয় দিবসের উদযাপনের বায়না ধরে। দেশপ্রেমিক বাবা ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ ইং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ছেলে মারওয়ান সহ ভারতের চেন্নাই সিএমসি হাসপাতালের বেডে বিজয় দিবস উদযাপন করেন।
তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মাসুদ ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে বিজয় দিবস উদযাপন নিয়ে একটি স্ট্যাটাস লিখেন। নিচে তার স্ট্যাটাসটি হুবুহু তুলে ধরা হলো
ভারতের মাটিতে ক্ষুদে বাঙালীর মহান বিজয় দিবস উদযাপন ও একজন পিতার- অন্যরকম অনুভূতি।
আজ মহান বিজয় দিবস।
এবারেই প্রথম মহান বিজয় দিবসে প্রিয় মাতৃভূমির বাইরে অবস্থান করছি। নিজ দেশে থাকা অবস্থায় প্রতিটি জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছি এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সফলতার সাথে জাতীয় দিবস গুলো পালন করেছি। কিন্তু এবার ভারতের মাটিতে বসে আমাদের অসুস্থ্য ছেলেকে নিয়ে অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে মহান বিজয় দিবস উদযাপন করছি।
যদিও কোন স্বাধীন দেশে ভিন্ন দেশের পতাকা উত্তোলন বিধি সম্মত নয়, তথাপিও ডক্টরস রুমে গিয়ে বুঝিয়ে বলেছি যে-“আজ বাঙালীদের মহান বিজয় দিবস। বঙ্গবন্ধুর আহবানে এই বিজয় আনার জন্য বাংলার স্বাধীনতাকামী ৩০ লক্ষ মানুষ বুকের রক্ত দিয়েছেএবং ২ লক্ষ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছে। একজন বাঙালী হিসেবে মহান এই দিবসটি আমি আমার ছেলেকে নিয়ে উদযাপন করতে চাই”। ডক্টরস রুম থেকে আমাকে প্যাডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টের প্রধানের বরাবরে লিখিত অনুমতির পরামর্শ দিলেন। প্যাডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্টের প্রধান ডঃ অমিতা জ্যাকবকে লিখলাম-
মহান বিজয় দিবস পালনে আমার তীব্র আকাংখা দেখে ডাক্তার হাসলেন এবং ২০ মিনিটের জন্য মৌখিক অনুমতি দিলেন। কিন্তু ছেলেকে হাসপাতালের বেড থেকে কোলে নিয়ে যখনই রওয়ানা করবো ঠিক তখনই নার্সরা আপত্তি করলো যে-পেশেন্টকে কোনভাবেই বাইরে নেওয়া যাবেনা। যাইহোক ডাক্তারের অনুমতির সত্যতা প্রমাণ সাপেক্ষে অনেক-অনেক কস্টে বুঝিয়ে অবশেষে রাজি করালাম।
আমাদের ছেলেকে নিয়ে লাল সবুজের পতাকা যখন উড়িয়েছি, কি যে এক অন্যরকম অনুভূতি ও ভাললাগা সেটি লিখে কিংবা বলে বুঝানো অসম্ভব। আমাদের ছেলেকে জাতীয় পতাকার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে শিখিয়ে দিলাম আর আমি-
“আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস
আমার মনে বাজায় বাঁশি”।
গুনগুন করে যখন গাইছি, কখন যে খুশিতে দু’চোখ ভিজে গেছে বুঝতেই পারিনি।
এই মহান বিজয় দিবসে আমাদের ছালেহ মারওয়ান চৌধুরীর সুস্থ্যতার জন্য মহান আল্লাহর রহমত ও সকলের দোয়া কামনা করছি।
সত্যিই আবিভূত জ্ঞাতরা সকলে। এমন দেশাত্মবোধ যাদের হৃদয়ে দোল খায়। তাদের জীবনের এ কঠিন সময়ে তাদের প্রিয় সংগঠন ও সরকারকে তাদের পাশে দেখতে চায় জাতি।