মুহাম্মদ রুশনী মোবারক
সাংবাদিক ও কলাম লেখক
একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের স্টেশনারি দোকানের নাম ‘অনেস্টি শপ’ ( সততার দোকান)। যেখানে খাতা কলম, পেন্সিলসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ আছে। কিন্তু কোনো বিক্রেতা নেই। শিক্ষার্থীরা তাদের দরকারি জিনিসটি নিয়ে নেয়। দাম পরিশোধ করে সেখানে নির্ধারিত একটি বাক্সে । শিশুকাল থেকেই সততা, আর্দশ, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, সৎ এবং নীতিবান মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতেই স্কুল কর্তৃপক্ষের এই উদ্যোগ।
স্কুলের শিক্ষার্থীদের নীতিজ্ঞানের এই শিক্ষা দেয়া হচ্ছে কারণ বাংলাদেশে সর্বস্তরে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে বলেই অনেকে মনে করেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায় তারা পরীক্ষামূলক এই প্রকল্প চালু করে বেশ আশাবাদী হয়েছেন। কারণ প্রায় সবাই যে পণ্যটি নিচ্ছে তার যথাযথ মূল্য পরিশোধ করছে।
“দেশের নৈতিক অধঃপতন দেখে আমরা শঙ্কিত। সততা শিক্ষার শুরুটা শিশু বয়স থেকেই হতে হয়। নৈতিকতার শিক্ষার সূচনা হওয়া দরকার সমাজ, পরিবার এবং স্কুল থেকে। এই গুলি মূল উৎস যেখান থেকে শিশু মৌলিক জিনিসগুলো গ্রহণ করছে।
বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ‘দের মতে, বাংলাদেশে পরিবার থেকেই শিশুরা ছোটখাট অন্যায় শিখে বড় হয়। ধরুন শিশুরা সবাই আঙ্গিনা বা মাঠে খেলা করছে সেখানে সামান্য কোন কিছু নিয়ে শিশুরা শিশুদের মাঝে মনমালিন্য কিংবা ঝগড়া হল, সেক্ষেত্রে কিছু পিতা মাতা সন্তান’কে প্রশ্রয় দিয়ে বলে তুমিও কি ওদেরকে কড়া করে বকে দিতে পারো নাই, কিংবা সন্তানের পক্ষ নিয়ে বাবা মা নিজেরাই ঝগড়া করে, ঐ সব দেখে তখন তার শিশু মনে সেটা দাগ কাটে, এভাবে স্বামী স্ত্রী কথা কাটাকাটি কিংবা অশোভন আচরন গুলিও শিশু মনে বিরুপ প্রভাব ফেলে। তারপর স্কুল কিংবা পাশের বাসা থেকে বই, কলম, পেন্সিল, খাতা, খেলনার জিনিস চুরি করে নিয়ে আসলে সেটাকেও কিছু বাবা মা প্রশ্রয় দেয়, সন্তানের জন্য সেটাও ভবিষ্যৎ এ চরম কাল হয়ে দাড়ায়। তারপর কিছু পিতা মাতা সন্তানের উশৃঙ্খলতা, জিনিসপত্র ভাঙ্গা, নষ্ট করাকেও সায় দেয়, তখন কিছু বাবা মা বলে কোন সমস্যা নাই তুমি নষ্ট কর আবার কিনে দিবো, তখন তার মনে প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের মূল্যায়ন’টা আর থাকবে না, সে সব কিছু নষ্ট করলেও তার বাবা মা তাকে নতুন ভাবে পূরন করে দিবে এমন ধারনা তার মাঝে তৈরি হয়ে যায়।
এই বিষয়টা মারাত্নক আকার ধারন করে, ছোট খাটো খেলনা, খাবারের জিনিস, টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিস হয়ত সামর্থ্যবান পিতা মাতা নষ্ট হলেও কিনে দিয়ে সন্তানের মনকে খুশি রেখেছে কিন্তু তার চাহিদার মাত্রটা যে শিশু কালেই পিতা মাতায় উচ্চ বিলাশী করে ফেলছে সেটা আর তাদের মাথায় থাকেনা, সে সন্তান যখন কৈশোরে পা রাখবে তখন তার যে কোন আকাশ কুসুম চাহিদা পূরনে বিন্দুমাত্র ব্যার্থ হলে তখন পিতা মাতার সাথে চরম অযাচিত আচরন করতে দ্বিধা করবেনা।
দেশের বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রচারিত বহুল আলোচিত কয়েকটি খবর আলোকপাত করলে বুঝা যাবে দূর্নীতি কিভাবে গ্রাস করেছে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার’কে, হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি , বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা ২২ ক্যারেটের সোনা পাল্টে গিয়ে ১৮ ক্যারেট হয়ে যায়, দিনাজপুরের কয়লা খনি থেকে দেড় লাখ টন কয়লা গায়েব হয়ে গেলো! গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চারটি ভবনের আসবাবপত্র ও ইলেকট্রিক সরঞ্জাম সরবরাহ কাজের চুক্তি মূল্য একশত ১৩ কোটি ৬২ লাখ ৯৪ হাজার টাকার স্হলে মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে ৭৭ কোটি সেখানে একটা বালিশের দাম ধরা হয়েছে ৫৯৫৭ টাকা, লোপাট হয়েছে ৩৬ কোটি! জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর গরীব মানুষেকে হাত ধোয়া শেখাবে তাতে খরচ হবে ৪০ কোটি টাকা। এখানে ৯ জন কর্মকর্তার পেছনে পাঁচ বছরে খরচ হবে আরো ৫ কোটি টাকা। গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অধীনে বিল্ডিং দেখে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য বিদেশে যাবে ৩০ কর্মকর্তা ব্যায় হবে ১৯ কোটি টাকা। রেল মন্ত্রণালয় ১৫০ টাকার তালার দাম ধরেছে ৫৫৫০ টাকা, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশে যাবে তাতে খরচ হবে ১৯ কোটি টাকা। ডাক বিভাগের বর্তমান মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র সরিয়েছে ৫৪১ কোটি টাকা! এসব দূর্নীতি যারা করে তাদের পরিবারকে এর দায় নিতে হবে কারন এর বিলাশী ভোগ পরিবারের স্ত্রী সন্তানরাই করে, রাষ্ট্র যখন অবৈধ উপার্জনের জন্য স্ত্রী সন্তানদেরও দূর্নীতির আশ্রয় প্রশ্রয় দাতা এবং ভোগকারী হিসেবে আইনের মুখামুখি দাড় করাবে তখন কিছুটা হলেও দূর্নীতি’র লাগাম টেনে ধরা যাবে বলে মনেহয়! আর না হয়
দূর্নীতির কালো টাকায় সামাজিক বৈষম্য তৈরি হতেই থাকবে। কিছু অযোগ্য লোভী প্রকৃতির মানুষ বিভিন্ন রকম দূর্নীতি করে হঠাৎ অর্থ বিত্ত, চাকরী, ব্যবসা বানিজ্য, গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে যাই তাদের সন্তানের মাঝেই বেয়াদবী, সম্মান, নীতি, নৈতিকতা, সততা, সুশিক্ষার অভাব প্রবল ভাবে পরিলক্ষিত হয়।
বাবার অবৈধ দূর্নীতির টাকায় ফুটানী করতে গিয়েই উশৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাই। যা ভবিষ্যৎ সমাজ ব্যবস্তার জন্য অশনিসংকেত।
“উঠতি ছেলে মেয়ে- তাদের সামনে তো কোনো আদর্শ নেই। কাকে অনুসরণ করবে? যে আদর্শগুলো সামনে আছে সেগুলো নিলে বরং অনৈতিক জিনিসই বেশি শিখবে।” বেশ কিছুদিন আগে শহীদ মিনারে সরকারি/ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণ-তরুণীরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজেরাই শপথ নেন। শপথে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা বলছিলেন পরিবার থেকেই কীভাবে দুর্নীতি আর অনিয়মের শিক্ষা মনের অজান্তেই তাদের ভেতরে ঢুকে যায়। “আমরা স্কুলে দেখেছি যে কেউ বিজ্ঞান বিভাগ পেল না। দেখা যায় তাদের বাবা/ মায়েরা এসে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দেয়ার চেষ্টা করে যে বিভাগটা যদি চেঞ্জ করা যায়। এই বাচ্চাগুলো যেটা দেখছে / শিখছে, ওরাও ঠিক নিজেদের বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সেটা করবে, চাকরি ক্ষেত্রেও এই চর্চ্চাই করতে থাকবে,” একজন তরুণী বলেন।
এক তরুণ বলেন, “অনেক বাবা-মাকে দেখা যাচ্ছে বাচ্চাদের ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র কিনে দিচ্ছেন। এর মধ্যে দিয়ে পরিবার থেকেই সে দুর্নীতি শিখছে। এবং এই চর্চ্চাটা থেকেই যাবে তার মধ্যে।” বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী আরো বলেন, সাময়িক বন্ধু বান্ধব পাড়া প্রতিবেশির সাথে সম্পর্কমনমালিন্য হতে পারে, সেটা নিজেদের মাঝেই রাখা উন্নত রুচির প্রকাশ। অনেক মানুষ বিষয়গুলি সন্তানকে শেয়ার করে অযাচিত বিভিন্ন কথা বলে শিশু মনে বিরুপ ক্রিয়া সৃষ্টি করে দেয়, যার কারনে প্রতিবেশি মুরব্বীদের সাথে হিংসা বিদ্বেষী, মনোভাব নিয়ে সন্তান বড় হয়, যার ফলে স্কুল কলেজে তার হিংসাটা প্রকাশ প্রায়, আচরনগত দিকে অন্য ভদ্র ছেলেদের সাথে, মিল থাকে না, হিংসাত্নক, হিংস্র, হিংসুক, অসামাজিক আচরনের কারনে ভদ্র সমাজ ও বিদ্যালয়ে বন্ধু মহলে ছোট হতে হয়। পৃথিবীতে যে দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম বলেই পরিচিত, তার জন্য রাষ্ট্র যতটা দায়ী তারচেয়ে অনেক বেশি দায়ী আমাদের সমাজ ও পরিবার। যেমন ধরুন আমাদের তরুন, কিশোর দের মাঝে কোন বন্ধু, পরিচিত কোন সিনিয়র ভাই, দামী আইফোন, রাডো ঘড়ি, দামী বাইক, দামী ব্র্যান্ডের পোষাক, দামী স্পোর্টস কার, ফেরারী, পোরশে, ল্যান্ড ক্রুজার সহ বিভিন্ন মডেলের গাড়ি ব্যবহার করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনেকে, সেসবের প্রতি আকর্ষন তরুন প্রজন্মের বেশি, ঐ সব জিনিস নিজেদের করে পাওয়ার জন্য পরিবারে বলে বাবা মা যখন তা পূরন করে দিতে পারে না! তখন আদরের সন্তান অপরাধে পা বাড়ায়। কে কিভাবে হঠাৎ অর্থ বিত্তের মালিক হয়ে জৌলুশ পূর্ণ জীবন যাপন করছে সেটার প্রতি কিছু তরুন তরুনীর আকর্ষনের কারনে কিছু পিতা মাতাও ঘুষ দূর্নীতি ‘তে জড়িয়ে পড়ছে। যা ব্যক্তিত্বহীনতা ও চরম নৈতিক অবক্ষয়। সাম্প্রতি স্বাস্হ্য বিভাগের মহাপরিচালকের সামান্য একজন ড্রাইভার নাম- মালেক , ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত যার লেখাপড়া সে ঢাকা শহরের ৩ টি বাড়ি, ২৪ টি ফ্ল্যাট সহ ১০০ কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। স্বাভাবিক ভাবেই তার জীবন যাত্রার মান রাজা বাদশার মত হবে কিন্তু একই ভাবে অন্য ড্রাইভার যারা সেখানে চাকরী করে তারা হয়ত সাধারন জীবন যাপন করছে, সামাজিক একটা বৈষম্য দূর্নীতিকে দারুন ভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে যার কারনে সামাজিক অস্তিরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আরেক তরুণ বলছিলেন, ছোটখাট অপরাধ দেখতে দেখতে এখন তারা কোনটা ভুল আর কোনটা সঠিক সেটাই বুঝতে পারেন না। “দুর্নীতির ব্যাপারটা আমরা এতটাই স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছি যে এখন বুঝতেই পারছি না কোনটা দুর্নীতি আর কোনটা দুর্নীতি না। এটা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের অংশ মনে হচ্ছে।” পরিবারের সব বাবা মা চান তাদের সন্তানরা সৎ, যোগ্য ও নীতিবান হোক। কিন্তু এ শিশুরা পরিবার সমাজ থেকে প্রতিনিয়ত এ অভ্যাসগুলোর মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছে। ছোট-খাট অন্যায় কাজ পরিবারের বড়দের দেখেই শিখছে শিশুরা। রাস্তায় দেখা যায় স্কুলের বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে পিতা-মাতারা ট্রাফিক আইন অমান্য করছেন। বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী’দের মতে, বাবা মা’ইতো বাচ্চাদের নিয়ে দেখা যায় চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। ফুটওভার-ব্রিজ ব্যবহার করছে না। এগুলো শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। সন্তানরা বাবা মা এবং পরিবার থেকে ভাল মন্দ দেখে শতকরা ৬০ ভাগ জিনিস শিখে, আর ৪০ ভাগ শিখে বিভিন্ন পরিবেশ, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কর্মক্ষেত্র থেকে। ছোট বাচ্চাদের সম্পর্কে বলা হয়, তারা খালি স্লেটের মতো। সেখানে আপনি যা লিখবেন সেটাই লেখা হবে। তার মানে ও যা দেখবে সেটাই শিখবে। এই অবজারভেশনাল লার্নিং-এর কিন্তু খুব বড় একটা ইমপ্যাক্ট আছে।” বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, শৈশবে পরিবার থেকে, সমাজ থেকেই সাধুতার শিক্ষা, নীতি এবং নৈতিকতার শিক্ষা মানুষ পায়। ছোটখাট অপরাধই বড় অন্যায় ও দুর্নীতির দিকে মানুষকে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে পরিবারের পিতামাতার উচিত যেকোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়া। পৃথিবীতে যে দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম বলেই পরিচিত। শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের তালিকায় অতীতে কয়েকবার বাংলাদেশ প্রথম স্থানেও উঠেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের গবেষণায় বিশ্বে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে ১ থেকে ৩০ তম অবস্থানের মধ্যেই থাকে বেশিরভাগ। এছাড়া টিআইবির গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সরকারি সেবা নিতে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাপক হারে বাংলাদেশের মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়।