[english_date] | [bangla_day]

খসে পড়ে ছায়ামানুষ, ইলিয়াস বাবর

বড় কন্ট্রাক থাকলে রাতে তেমন ঘুম হয় না আরিফের। শেষরাত থেকে এদিক-ওদিক করে বিছানায়। আরিফুল ইসলাম শহরের ডাকসাইটে ফটোগ্রাফার। ব্যাচেলর-স্মার্ট আরিফের ফটোর হাত পরিপক্ক, ভিন্ন ব্যঞ্জনে ভরা। সেল্ফ-সিগনেচার বলে যে কথাটা শোনা যায়, তার ছবিতে তা খাপের খাপ। আজ মনটা তার ফিরে যায় দূরের দিনে, যে-দিনের আলো-আঁধার জানে না এখনকার বন্ধুবলয়, জানে না পত্রিকায়লারা।

২.
দিনের মধ্য ভাগ। কড়ারোদে শহরের জটহীন রাস্তা। সময়হীন কেউ ফিরেও তাকায় না কারো দিকে। অলিখাঁ মসজিদের ডানে বিরাট ডাস্টবিন ঘেষে ঘুর ঘুর করছে কিছু ছেলে, দুটো কুকুর। ক্ষুধার্ত আরিফ নিজেকে ভাবে ছেলে আর কুকুরদের প্রতিযোগী। ঝুঁকে কিছু একটা নিতে যাবার আগেই অচেনা একটা হাত নেমে আসে তার কাঁধে। ভদ্রলোক কথা না বাড়িয়ে রিক্সায় আরিফকে নিয়ে যায় অফিসে। অনলাইন নিউজ পোর্টালের অফিস, অন্য ব্যবসাও আছে। ভদ্রলোক লিকলিকে, ফর্সা চেহারা; শরীরভাষ্য বলে শিক্ষিত, বড়ঘরের সন্তান। খাবার শেষে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে এটা-ওটা। তোমার শখ কী? প্রশ্ন শুনেই আরিফ বলে, পেট ভরে ভাত খাওয়া। দুজনকে তখন ভর করে নিরবতা, কথারা জিরিয়ে নিচ্ছিল তাদের বুকে। গ্রামে থাকতে আরিফ শুনেছিল, ফেরেস্তারা ভালো মানুষ হয়ে আসে দুনিয়ায়। অথচ সে নিজের চোখে দেখেছিল, শয়তানেরাও নেমে আসে মানুষের সুরুতে!

৩.
চায়ের দোকানে সারাদিন খেটে রাতে শান্তিতে ঘুমাবে সে জো ছিল না আরিফের। দোকানে বড় চৌকিতে ঘুমাতে হয় সহকর্মীদের সাথে, পাশের খাটে মালিক। গভীর রাতে আরিফ আবিষ্কার করে, তার লুঙ্গি থাকে না যথাস্থানে, কেউবা টেনে নেয় জোর করে। হাসফাস করে সে, পালিয়ে বাঁচে দুর্বিসহ যন্ত্রণা থেকে। না, এসব কথা বলা যায় না জিয়াউল হক জোহান– তার বস, নিউজ পোর্টালের সম্পাদককে। এখন দরকার স্থিতি, একটা আশ্রয়। আরিফ কেবল বলেছে, মা আরেক বিয়ে নিচে, চাচারা বের করে দিচে বাড়ি থেকে।

৪.
অফিস পরিস্কার রাখা, চা-পানি আনা ইত্যাদিকে অতীত করে আরিফ তখন নিউজ পোর্টালের ফটোগ্রাফার! প্রেসকার্ডে জ্বল জ্বল করছে আরিফুল ইসলাম, (এম. এ), সহ-সম্পাদক। গোঁফচুলে কিছুটা দেখালেও আরিফের বয়স মাস্টার্সের কোটায় পৌঁছতে ঢের বাকি, এমনকি পড়াশোনায় নিন্মমাধ্যমিকও মাড়ায়নি, তা জানে সম্পাদক। কার্ডের শোভা বাড়াতে নয়, আরিফের জোরাজুরিতেই এই লকব দেয়া। অফিসের কোন এক অনুষ্ঠানে সবাই যখন ছবিতে মুখ দেখাতে ব্যস্ত, আলগোছে ক্যামেরাটি হাতে নেয় আরিফ। সেদিন তার ছবির প্রশংসা করেছিল স্বয়ং সম্পাদক, যিনি কি না জাতে খুঁতখুঁতে স্বভাবের।

৫.
আরিফ এখন ফ্রিল্যান্সার ফটোগ্রাফার। আরো আগে ছেড়ে দিয়েছে নিউজপোর্টাল অফিস। সিগারেট ফুকার অবসরে এক বন্ধুই তাকে বলেছিল, ইন্টারন্যাশনাল এক কনটেস্টের কথা। অনলাইনে রেজিষ্ট্রেশন করে পাঠিয়ে দেয় ছবি। মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো রানারআপ হয় বাংলাদেশী আরিফের ডাস্টবিনকে কেন্দ্র করে তোলা ছবি। স্থানীয়-জাতীয় কাগজে তাকে নিয়ে হয় ফিচার-নিউজ। বলতে গেলে সেই প্রাইজের ভরে তার জীবন আজ ফকফকা। যেখানে নিউজপোর্টালের জোহান সাহেবের খবর নেয়ার সময় হয় না; যিনি কিনা তাকে কিনে দিয়েছিল ক্যামেরা, দেখিয়েছিল ছবির ব্যাকরণ। অলিখাঁ মসজিদের ডানে ডাস্টবিনের পাশঘেষা রাস্তা ধরে যাওয়া হয় না অনেক দিন। এখনকার আড্ডা চেরাগি কি স্টেডিয়ামে। ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে ওসব আড্ডায় হাতি-ঘোড়া মারার সাথে উঠে আসে রাজ্যের কথাবার্তা।

৬.
ভোরের কুয়াশা ভেদ করে হাতব্যাগটি নিয়ে বেরিয়ে যায় আরিফ। একবার আড়চোখে তাকায় দরজার দিকে, চোখ যায় তারই এককালের সাদা-কালো ছবির দিকে। চমৎকার একটা হাসি জিইঁয়ে আছে ঠোঁটের কোণে। ঠিক করেছে, সনদ-ক্রেস্ট সেই ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে ফার্স্ট ট্রিপের বাসে চলে যাবে গ্রামে। ভরাপেট, অশিক্ষিতের নামের পাশে এম.এ আর গেঁয়ো মিথ্যুকের গায়ে ওসব দামি আবরণ তার কোনভাবেই পোষায় না আর!

ইলিয়াস বাবর
চট্টগ্রাম
০১৮২১৫৮৯৬৯৮

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

পাঠক প্রিয়