[english_date] | [bangla_day]

শ্রীলঙ্কার নিরুদ্দেশ যাত্রা

চিটাগাং মেইল ডেস্ক: শ্রীলঙ্কার জাতীয় দৈনিক দ্য আইল্যান্ড-এর মতামত পাতায় একজন লিখেছেন, যে মানুষটি কোনোদিন শ্লোগান তো দূরের কথা, জোরেও কথা বলেনি, রাজনীতি নিয়ে কখনো মাথা ঘামায়নি সে এখন রাজপথে, যে পরিবারের বাইরে কখনো সময় কাটায়নি সে ফিরছে না মিছিল থেকে, যে মা সবসময় আগলে রাখতে পছন্দ করতো সেও সন্তানকে পাঠিয়ে দিচ্ছে বিক্ষোভে সামিল হতে।

বর্তমান পরিস্থিতি শুধু অগ্নিগর্ভ নয়, বলতে গেলে জ্বলছে দ্বীপ রাষ্ট্রটি। যত সময় গড়াচ্ছে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। জোরদার হচ্ছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। প্রথমে কিছুটা প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও এখন সরকার পক্ষের লোকজন দৌড়ের ওপর আছে বলতে হবে। বিক্ষোভকারীদের হামলায় মারা পড়ছে। একজন সাংসদ নিজেকে বাঁচাতে আত্মহত্যা করেছেন। আহত হচ্ছে শত শত। প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের পর বিক্ষোভে আরও জ্বলে ওঠে শ্রীলঙ্কা।

 

YouTube player

কয়েক মাস ধরে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে শ্রীলঙ্কা। প্রায় দেড় দশক আগেই সাবধান বাণী শুনিয়েছিলেন দেশটির অর্থনীতিবিদদের একাংশ। তারা বলেছিলেন, তামিল বিদ্রোহীদের নির্মূল করতে মরিয়া শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) মাহিন্দা রাজাপাকসের সামরিক খাতে বিপুল ব্যয়ের সিদ্ধান্ত সে দেশের অর্থনীতির ভিত দুর্বল করে দিতে পারে। ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটির বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, সেই আশঙ্কা পুরোপুরি অমূলক ছিল না।

তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের জেরে খাবার, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, সব জায়গায় টান পড়েছে, কমেছে সে দেশের মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা। মানুষের বিক্ষোভ সামলাতে সামরিক বাহিনীকে ডাকা হচ্ছে, কার্ফু জারি হয়েছে। যারা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী, সেই ক্ষমতাসীনদের গদিচ্যুত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের অবস্থা এখন এতই অস্থির, সংকটজনক যে, তার সমাধান করার, স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানোর দায়িত্ব কেউ নিতে চাইছে না। নেওয়ার ক্ষমতা কারও আছে বলেও মনে হচ্ছে না।

এক সমৃদ্ধ দেশের দিশা দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৯ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন রাজা পাকসে। কিন্তু শুরু থেকেই রাষ্ট্র ও সরকারে পরিবারতন্ত্রের আধিপত্য তৈরির প্রচেষ্টা শুরু করেন তিনি। প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া নিজের বড় ভাই মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেন এবং স্বজনপোষণের এক ভয়ানক নিদর্শন দেখিয়ে নিজের আরও দুই ভাইকে মন্ত্রিত্বের আসনে বসান। এক ভাই বসেন অর্থমন্ত্রীর পদে।

কয়েক মাস ধরে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে শ্রীলঙ্কা। প্রায় দেড় দশক আগেই সাবধান বাণী শুনিয়েছিলেন দেশটির অর্থনীতিবিদদের একাংশ…

রাজাপাকসের পরিবারের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে শ্রীলঙ্কার এগারোটা মন্ত্রণালয় ভাগাভাগি করে নেন। মানুষের ক্ষোভ তাই পুরো পরিবারের ওপর। এই পরিবার বরাবরই দেশের মানুষের থেকে বিপুল সমাদর, সমর্থন পেতে অভ্যস্ত। আজ তারা পড়েছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে। মানুষের ধাওয়ায় তাদের পালাতে হচ্ছে আজ।

চরম আর্থিক সংকটের কারণে বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধে অপারগতার কথা জানিয়ে লঙ্কার সরকার তার দেশকে ‘ঋণখেলাপি’ ঘোষণা করেছে কিছুদিন আগেই। আন্তর্জাতিক ঋণ এবং সুদ মেটাতে সরকারের কাছে কোনো অর্থ নেই। সরকারেরই অনেকগুলো ভুল সিদ্ধান্তের ফলে এই সংকট তৈরি হয় এবং ঋণের ফাঁদে পড়ে দেশটি।

করোনাভাইরাস মহামারি আকার নিলে আরও বড় বিপদে পড়ে দেশটি। অতিমারি পরিস্থিতি থেকেই ধীরে ধীরে আর্থিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রবল হচ্ছিল। ২০১৯-এর শেষ পর্বে শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ৯৪ শতাংশ।

২০২১-এর শেষ পর্বে তা ১১৯ শতাংশে পৌঁছায়। ফলে বিদেশি ঋণ পাওয়ার পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। জানুয়ারির গোড়াতেই সে দেশে মূল্যবৃদ্ধি ২৫ শতাংশ ছুঁয়ে রেকর্ড গড়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ পর্বে তলানিতে ঠেকেছিল বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়।

আন্তর্জাতিক বন্ড, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পাশাপাশি কলম্বোর বিদেশি ঋণের বড় অংশ চীন থেকে নেওয়া। একটা প্রচারণা আছে যে, সংকটের সময় চীনের শি জিনপিং সরকারকে সেভাবে শ্রীলঙ্কার পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। বরং আগামী দু’বছরের মধ্যে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য দেওয়া প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার পরিশোধের জন্য চাপ দিয়েছে চীন। কিন্তু এক তরফা চীনকে দায়ী করা ঠিক ন্যায্য নয় এ জন্য যে, শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের দশ ভাগ চীন থেকে নেওয়া।

ঋণখেলাপি শ্রীলঙ্কার সর্বনাশের মূল কারণ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় বন্ড বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে অব্যাহত গতিতে বিক্রি করা। শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের ৪৭ শতাংশ বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন বন্ড ইস্যু করে নেওয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো, শ্রীলঙ্কার সরকার ঢালাওভাবে ডলারে সেভিংস ইন্স্ট্রুমেন্ট বিক্রি করেছে। এই ডলার-ভিত্তিক সেভিংস ইন্স্ট্রুমেন্ট দেশটির সর্বমোট বৈদেশিক ঋণের প্রায় অর্ধেক। রাষ্ট্রীয় রিজার্ভে ডলারের পরিমাণ তলানিতে ঠেকার কারণে এই সঞ্চয়পত্রের কিস্তি-ভিত্তিক লাভের টাকা দিতে শ্রীলঙ্কার সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

তাই সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, শ্রীলঙ্কার এ সমস্যা রাতারাতি তৈরি হয়নি। গত ১৫ বছর ধরে এ সমস্যা পুঞ্জীভূত হয়েছে। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে দেদারসে ঋণ নিয়েছে শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সরকার। একটি দেশের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে এ ধরনের সার্বভৈৗম বন্ড বিক্রি করা হয়। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে এ ধরনের বন্ড বিক্রি করে অর্থের জোগান দেওয়া হয়। শ্রীলঙ্কা সেটাই করেছে।

শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার বড় জোগান আসে দেশটির পর্যটন খাত থেকে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর পর্যটন শিল্পে কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় চরম সংকটে পড়েছে দেশটি।

কিন্তু এই অর্থ কীভাবে পরিশোধ করা হবে সে ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করেনি। শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার বড় জোগান আসে দেশটির পর্যটন খাত থেকে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর পর্যটন শিল্পে কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় চরম সংকটে পড়েছে দেশটি। মহামারি শুরুর আগে শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসতো চীন থেকে। কিন্তু চীনে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ কঠোর থাকায় চীন থেকে পর্যটক আসতে পারেনি। এর ফলে দেশটির পর্যটন খাতে বিপর্যয় নেমে আসে।

আরেকটি বড় কারণ ছিল, কৃষি খাতে অর্গানিক পদ্ধতির চিন্তাহীন ব্যবহার। রাসায়নিক সার বন্ধ করে সম্পূর্ণ জৈব চাষে যাওয়ার ফলে ফসল উৎপাদন মার খেয়েছে, দেখা দিয়েছে কৃষির সংকট। এর অংশ হিসেবে শ্রীলঙ্কায় সার আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল কৃষিক্ষেত্রে।

এতে চালের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যায়। একসময় চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের চাল আমদানি করতে। চালের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। অর্গানিক কৃষির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল দেশটির চা উৎপাদনেও। চা রপ্তানি করে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। সেখানেও বড় ধাক্কা লাগে। অর্গানিক কৃষি চালু করার আগে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা করা হয়নি। এতে উল্টো ফল হয়েছে।

শ্রীলঙ্কায় বন্দরের মতো জাতীয় সম্পদ বিক্রি করা, বিপুল ঋণের বোঝা তৈরি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে যে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়, তা ছিল না দেশটিতে। শ্রীলঙ্কায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটি হয়নি।

বিদেশি বিনিয়োগের পরিবর্তে বিভিন্ন সরকার বিদেশি দেশ ও সংস্থা থেকে ঋণ করে বড় প্রকল্প করার প্রতি মনোযোগী ছিল বেশি। এসব প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে কতটা ফলদায়ক তার কোনো সত্যিকারের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সততার সাথে করা হয়নি। ঋণ করে প্রকল্প করা, সেগুলো করতে গিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি দেশটিকে লুটেরা অর্থনীতিতে পরিণত করে।

পদত্যাগপত্রে রাজাপাকসে লিখেছেন, দেশকে বর্তমানের অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের করে আনতে সর্বদলীয় সরকার গঠনের পথ করে দেওয়ার জন্য তিনি সরে যাচ্ছেন। কিন্তু সেটি সহজ কাজ নয় কারণ কোনো বিরোধী দলই সরকারে যোগ দিতে রাজি নয়।

এ ধরনের সরকার বুঝতেই পারে না যে তারা ক্ষমতার লোভে আস্তে-আস্তে স্বৈরাচারে পরিণত হয়, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সংকট চলছে এবং চলবে অনেকদিন। মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করেলন, কিন্তু বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করবে কে? অর্থনৈতিক মুক্তি আনবে কে? – এসব প্রশ্নের উত্তর জানে না কেউ দেশটিতে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টিভি

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

পাঠক প্রিয়