ইফতারের শাহী বাজার পুরান ঢাকার চকবাজার লকডাউনে জনশূন্য
মুহাম্মদ রুশনী মোবারক –
ঢাকা থেকে ফিরে :-
নানা বাহারি আয়োজনের পুরান ঢাকার ইফতার স্বাদ ও ঐতিহ্যে বাংলাদেশের মধ্যে অন্যতম সেরা। বিশেষ করে সমগ্র ঢাকার মানুষই পুরান ঢাকার ইফতারের আলাদা একটা কদর করেন। তবে এবার লকডাউনের মধ্যে পুরান ঢাকার চকবাজারে আগের মত জমজমাট ভাবে বসেনি ইফতারের বাজার।
আর এ এলাকার মানুষের ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ ছাড়া ইফতার যেন জমেই না। তবে এবার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের দেয়া লকডাউনে পুরান ঢাকার চকবাজারে বসেনি ইফতারের বাজার।
‘আসব না? এই তো একটু ঘুরতে এসেছি। সব স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তো বেরিয়েছি।’ লকডাউনে বাইরে বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করতেই বিরক্তির সুরে এ কথা বলেন স্থানীয় এক যুবক। তিনি রাজধানীর চকবাজার শাহী মসজিদের ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চকবাজারে ইফতারসামগ্রী কিনতে এসে পর্যাপ্ত পরিমানে না পেয়ে চরম হতাশ ওই যুবক।
যুবক বলেন, ‘আমাদের পুরান ঢাকার মানুষ বাসায় ইফতারের বিভিন্ন আইটেম তৈরি করলেও ঐতিহ্যগত ভাবে চকবাজারের হরেক রকম ইফতার কিনে নিয়ে পরিবারের সবার সাথে খাওয়ার মজাটায় অন্যরকম, তাই মুরব্বী বাপ দাদা, নানা, মামা, চাচা, বড় ভাইদের দেখানো পথেই ঐতিহ্যবাহী চকবাজার থেকে বাহারী ইফতার কিনে খাওয়ার অভ্যাস। গত বছরের মতো এবারও তো সেভাবে দোকান বসেনি। তবুও টুকটাক যা দোকান বসেছে, সেখান থেকে কিনতে এসেছি।’
চকবাজারের রমজানে দুপুর না হতেই শাহী মসজিদ গলিসহ আশপাশের এলাকাজুড়ে বাহারি ইফতার বানানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। গোটা এলাকায় থাকত মানুষের প্রচন্ড ভিড়। বিক্রেতারা চিৎকার করে বলতেন, ‘বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায়।’
এখানে বিক্রি হতো আদি মাঠা, আস্তখাসি, খাসির লেগ পিস, মুরগী মসাল্লাম, চিকেন ফ্রাই, বটি কাবাব, টিক্কা কাবাব, কোফতা, চিকেন কাঠি, সামি কাবাব, শিকের ভারি কাবাব, সুতি কাবাব, কোয়েল পাখির রোস্ট, কবুতরের রোস্ট, জিলাপি, শাহি জিলাপি, নিমকপারা, সমুচা,
বিখ্যাত আলাউদ্দিনের হালুয়া, হালিম, দইবড়া, সৌদি পানীয় লাবাং, কাশ্মীরি শরবত।
হরেক ফলের দোকানে ছেয়ে যেতো গোটা চকবাজার। ক্রেতা-বিক্রেতার উপস্থিতিতে জোহরের নামাজের পর থেকেই ধুমছে বেচাকেনা শুরু হতো। চকবাজারের আদি ইফতারি তৈরির সঙ্গে জড়িত প্রবীণরা গল্পের ঝুলি মেলে ধরে বাপ দাদার আমলের ইতিহাস তুলে ধরতো। কিন্তু মহামারি করোনার কারণে সেই চকবাজার এবারও বড় পরিসরে ইফতারের বাজার বসেনি।
সোমবার (১৮ এপ্রিল ) পবিত্র মাহে ৬ রমজান সরেজমিন পরিদর্শনকালে চকবাজার চৌহদ্দি ঘুরে ইফতারের তেমন কোন বাজারের দেখা মেলেনি। বহু বছরের পুরোনো আনন্দ বেকারি, আলাউদ্দিন সুইটমিটসহ কয়েকটি কনফেকশনারি ও মিষ্টির দোকানে স্বাস্থবিধি মেনে ইফতারসামগ্রী বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এদিক-সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছুসংখ্যক মাঠা, পিস শসা, কলা, আনারস, তরমুজ, বাঙ্গি, মাল্টা ইত্যাদি ফলমুল বিক্রি হতে দেখা গেছে। চকবাজারের ঐহিত্যবাহী শাহি মসজিদে তালা ঝুলতে দেখা যায়। একজন মুসল্লি জানালেন, শুধুমাত্র ওয়াক্তের সময় সীমিত সময়ের জন্য মসজিদ খোলা হয়।
তিনি বলেন, চকবাজারে জোহর ও আসরের নামাজ পড়ে ইফতার কিনে নিয়ে যেতো পুরান ঢাকা, নতুন ঢাকা ও অভিজাত এলাকা বারিধারা, গুলশান, ধানমন্ডি, বনানী সহ আশপাশের মানুষ। কিন্তু গত বছর ও এবার লকডাউনের কারণে ইফতারের তেমন বাজারই বসেনি। এলাকার প্রবীণ এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় বলছিলেন, ‘করোনার কারণে বড় বাপের পোলায় খাই, কই হারাইয়া গেল!’
জনশূন্য হয়ে আছে সব মার্কেট, রাস্তাঘাট। হাতেগোনা কয়েকটি খাবারের দোকান ছাড়া এলাকার সব দোকান বন্ধ।
এ বিষয়ে পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী জানান, পুরান ঢাকার ইফতার শুধু এই এলাকার নয় বরং সমগ্র ঢাকার অন্যতম আগ্রহের জায়গা। এটি একটি ঐতিহ্যও বটে। তবে এবার রমজানে সেই ঐতিহ্য আর স্বাদ থেকে ভোজন বিলাসীরা যেমন বঞ্চিত হবেন, তেমনি ব্যবসায়ীরাও হবেন ক্ষতিগ্রস্ত।
এদিকে পুরান ঢাকায় চকবাজার এলাকায় লকডাউনে টহলরত বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জনসমাগম এড়াতে এবার ইফতারের বাজার বসতে দেয়া হয়নি। বরং সবাইকে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সচেতন করতে তারা তৎপর রয়েছেন।