[english_date] | [bangla_day]

করোনা পরিস্থিতি: কেন কঠোর নিষেধাজ্ঞা?

ড. জেবউননেছা: করোনাকালীন রাজধানীর একটি রেস্তোরাঁ সবসময় ক্রেতা দিয়ে রাত অবধি পূর্ণ থাকে। একদিন আমিও জায়গা পাওয়ার অভাবে ফিরে এসেছিলাম। করোনার সময়েও ছুটির দিনে ও একটি বুফে রেস্তোরাঁয় বেশ কয়েকদিন বুকিং দিতে গিয়েও পাইনি। কারণ বুকিং হয়ে যায় আগেই।

হাট-বাজারে, শপিংমলে, গণপরিবহনে, পার্কে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মানুষের অবাধ চলাচলের প্রেক্ষিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। এ প্রেক্ষিতে সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের পক্ষ থেকে এসেছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু কেন এলো সেই নির্দেশনা একবার কি ভেবে দেখেছি?

একটি কথা কেন বুঝতে পারছি না আমরা সবাই। আমি বাঁচলে বাঁচবে আমার পরিবার। এটুকু মনে করে একটু সতর্ক থাকি। সংক্রমণ ঠেকাই। ধৈর্য ধারণ করি…
যাই হোক, কঠোর নিষেধাজ্ঞার শুরুর দিনে ঢাকা থেকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দাপ্তরিক কাজের জন্য যাই। প্রচণ্ড যানজটে কেটে গেল বেশকিছু সময়। পথে যেতে যেতে সাধারণ মানুষের চলাচল ছিল লক্ষণীয়। তবে বেশিরভাগ মানুষের মুখে মাস্ক চোখে পড়েনি। বাসায় ফিরে সন্ধ্যায় বের হই কল্যাণপুরের দিকে। রাত ৯ টায় বাসায় ফেরার সময় কল্যাণপুর থেকে আসাদ গেট পর্যন্ত আসার জন্য রিকশা, সিএনজি ভাড়া হয়ে গেল তিনগুণ।

কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড যেহেতু দেশের বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। সেখানে লক্ষ্য করেছি গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য শত শত মানুষের ভিড়। একই চিত্র। মাস্কহীন মুখ। রিকশায় গাদাগাদি করে বসেছে। তাও মাস্ক ছাড়া।

দর্জির দোকানে গিয়ে দেখি দর্জি খুব তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করার চেষ্টা করছেন। আমাকে বললেন, ‘আপা, দর্জিগিরি করে সংসার চালাই। দোকান যদি বন্ধ রাখি, সংসার চালাব কী করে।’ কথাটি মনে দাগ কেটে যায়। ঠিকইতো এই সাধারণ মানুষের ভোগান্তির সীমা পরিসীমা নেই। কল্যাণপুর থেকে আসাদ গেট যানজট পেরিয়ে যেতে লাগল আধ ঘণ্টার বেশি সময়। বাস থেকে নামার পর চোখে পড়ে শত শত মানুষের পদযাত্রা। গন্তব্য তাদের গ্রামের বাড়ি। মনে হচ্ছিল যেন ঈদের ছুটি। মনের মধ্যে প্রশ্ন ভিড় করে, আচ্ছা সাতটি দিনও কি আমরা বাসায় থাকতে পারি না? এত ধৈর্যহীন হয়ে পড়ি কেন আমরা?

পরদিন দুপুরে অর্থাৎ কঠোর নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিন রোগী নিয়ে যাই রাজধানীর একটি চক্ষু হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখি রোগীদের ভিড়। বিকেলে রিকশায় মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারে গিয়ে চোখে পড়ল কিছু রেস্তোরাঁ খোলা রাখা হয়েছে। তবে ভিতরে বসার ব্যবস্থা নেই। চেয়ার উল্টো করে রাখা।

সবজির দোকানে গিয়ে দেখি নেই ক্রেতা, নেই বিক্রেতা। ফেরার সময় রিকশাওয়ালার কাছে জানতে চাই। কেমন উপার্জন করেছেন, জানালেন দুপুরের পর মাত্র দু’জন যাত্রী পেয়েছি। ভাবতে ভাবতে ফিরে আসি বাসায়। ভাবতে থাকি দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, খেটে খাওয়া মানুষ তাদের কী হবে? কীভাবে বেঁচে থাকবে তাদের পরিবার। এইসব ভোগান্তি তৈরির জন্য কি আমরা দায়ী নই?

গণমাধ্যমে একটি ছবি ঘুরছে। একটি পরিবার ট্রাকে চড়ে হাড়ি-পাতিল নিয়ে গ্রামের দিকে ছুটছে। আমার প্রশ্ন এভাবে কি তাদের যাওয়ার কথা ছিল? না। তাদের এবং আমাদের অসচেতনতায় আজ আমরা সংক্রমিত দেশের তালিকায় স্থান করে নিয়েছি। সরকার নির্দেশনা প্রদান করতে পারবেন। কিন্তু সে নির্দেশনা পালন করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। যখন নির্দেশনার সাথে আমাদের চলাচলের সমন্বয়হীনতা থাকবে তখনই ঘোর বিপদ। সেই বিপদেই আজ আমরা সবাই।

সামনে রমজান। বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা মাসটির জন্য অপেক্ষা করেন। যদিও শপিং মল থেকে দোকানপাট সীমিত পরিসরে খোলা। তাতে কি? ক্রেতাও যে সল্প। ব্যবসায়ীদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা কী হবে তা সহজেই অনুমেয়। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, ক্রেতা-বিক্রেতা উভয় মহলেই স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যপারে অনীহা।

সাধারণ জনগণের সচেতনতার অভাবে আজ আমাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হয়েছে। করোনাকালীন সময় পর্যটকের বিশাল ঢেউ, বিয়ে, জন্মদিন সবকিছুতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধ চলাচল আজ আমাদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা বীরের জাতি এটা সর্বজনবিদিত। কিন্তু ক্ষুদ্র একটি ভাইরাস যেখানে বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে ফেলছে, তখন আমাদের মানসিক বীরত্ব কি হেরে যাবে শরীরের কাছে? একটি কথা কেন বুঝতে পারছি না আমরা সবাই। আমি বাঁচলে বাঁচবে আমার পরিবার। এটুকু মনে করে একটু সতর্ক থাকি। সংক্রমণ ঠেকাই। ধৈর্য ধারণ করি।

কয়দিন আগে প্রধানমন্ত্রী মহান জাতীয় সংসদে তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে বলেছেন, ‘করোনার টিকা এলো। মানুষ মনে করেছে করোনার আর ভয় কি? দেদারসে ঘুরছে ফিরছে মানুষ। এই ফাঁকে বেড়েছে করোনা। সংক্রমণ ঠেকানোর জন্যই কঠোর নিষেধাজ্ঞা।’ মনে পড়ে করোনাভাইরাস যখন সারা বিশ্বে ছোবল দিয়ে যাচ্ছিল তখন সরকারের দৃপ্ত পদক্ষেপে সবার সচেতনতায় প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল করোনাভাইরাস সংক্রমণ। অতঃপর করোনাভাইরাসের টিকা বাংলাদেশে আসার পর সবার আগ্রহের ভিত্তিতে জনপ্রিয়তা লাভ করছিলো, ঠিক তখনই বেড়ে গেল পুনরায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ।

বাড়বেই না কেন, সাধারণ জনগণের সচেতনতার অভাবে আজ আমাদের কঠোর নিষেধাজ্ঞায় পড়তে হয়েছে। করোনাকালীন সময় পর্যটকের বিশাল ঢেউ, বিয়ে, জন্মদিন সবকিছুতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অবাধ চলাচল আজ আমাদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলের সম্মিলিত অসচেতনতায় আজ সাধারণ মানুষ দুর্ভোগে। সামাজিক দূরত্ব মেনে, মাস্ক পরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। সূর্য একদিন উঠবেই। সেই সোনালি সূর্যের আলো উপভোগ করার জন্য সকলে সচেতন হই।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সূর্য ডুবে যায়। সন্ধ্যা নেমে আসে। রাজপথে তাকিয়ে দেখি গুটিকতক সিএনজি, মালবাহী ট্রাকের আনাগোনা সেইসাথে বীরদর্পে রাজপথে চলছে হাতেগোনা কয়েকটি রিকশা। অপেক্ষায় থাকি, আবার প্রচণ্ড হর্নের শব্দে ঘুম ভাঙবে, চঞ্চল হয়ে উঠবে নগরী। সেই প্রার্থনা করছি দিনমান।

লেখক: ড. জেবউননেছা ।। অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

পাঠক প্রিয়