[english_date] | [bangla_day]

ভারতীয় সিরিয়ালের প্রতি আসক্তি সামাজিক অবক্ষয় চুড়ান্ত পর্যায়ে –

ভারতীয় সিরিয়ালের প্রতি আসক্তি সামাজিক অবক্ষয় চুড়ান্ত পর্যায়ে –

মুহাম্মদ রুশনী মোবারক
(সাংবাদিক ও কলামিস্ট)

ভারতীয় সিরিয়াল অনেক আগে থেকেই তথাকথিত কিছু পরিবারের কাছে খুবি জনপ্রিয় । প্রতিদিনই নতুন নতুন পর্ব, অাজগুবী বিভিন্ন কাহিনী করে পর্ব দীর্ঘ করা আর ঘটনার কাল্পনিক চমকের কারণে অনেকের কাছে সিরিয়ালগুলো এখন নেশার মত। সন্ধ্যা হলেও শহর, মফস্বল থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম সবখানেই একচেটিয়া আধিপত্য শুরু করে ভারতীয় সিরিয়ালগুলো।

এমন ভয়ংকর নেশায় মত্ত হয়ে আছে বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী। কলকাতার স্টার জলসা, জি বাংলা কিনবা হিন্দিতে স্টার প্লাস, স্টার ওয়ান, জি টিভিতে চলা সিরিয়ালগুলো নারীদের কাছে খুবই তথাকথিত সস্তা জনপ্রিয়তা। এমনকি কিছু অল্প শিক্ষিত পুরুষও আজকাল ঘটা করেই দেখছেন এসব সিরিয়াল।
মহানগরের পাশাপাশি মফস্বল, গ্রামেও ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এই আসক্তি। আর ভারতীয় সিরিয়ালের বিষাক্ত ছোবলের ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়ছে পরিবার ও সমাজের উপরে।

আসুন জেনে নেয়া যাক ভারতীয় সিরিয়ালের বিরূপ প্রভাবগুলো – যা মূলত ধ্বংস করছে আপনার জীবন সেই সাথে পরিবার ও সমাজ ব্যবস্তা।
সংসারে ‘কুটনামি’ করে অশান্তি বৃদ্ধি করা ভারতীয় সিরিয়াল গুলোর মূল উপাদান নিঃসন্দেহে কুটনামি। প্রতিদিনই সিরিয়ালে দেখানো হচ্ছে শাশুড়ি-বৌ, ভাইয়ে ভাই , ভাই বোন এর বিভিন্ন রকম নোংরা কুটনামি, তিন জা এর নিম্নরুচির কুটনামি কিংবা পরিবারের অন্যদের সঙ্গে মিথ্যা বলে ফাদে ফেলা, ষড়যন্ত্র ও কুটনামি। সিরিয়ালে দেখানো এসব ঘটনা ‘স্লো পয়জন’ এর মত কাজ করছে অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত, মূর্খ নারীদের ওপর। নিজের অজান্তেই কুটনামি করা শিখে ফেলছেন ঐসব নারীরা। এক পর্যায়ে মনের বিকৃতির কারণে কুটনামি করেই বিকৃত রুচির বিনোদন পাচ্ছেন আমাদের সমাজের কিছু সংখ্যক সিরিয়াল প্রেমীরা।
সাধারণ বিষয়কেও জটিল মনে করে মানসিক চাপে ভোগা
সাধারণ বিষয়কেও জটিল মনে করে মানসিক চাপে ভোগা ভারতীয় সিরিয়ালে অনেক সাধারণ একটি বিষয়কেও জটিল করে দেখানো হয়। আর তাই যারা নিয়মিত এসব সিরিয়াল দেখে তাদের কাছে খুব সহজ, সাধারণ একটি বিষয়কেও অনেক বেশি জটিল ও কুটিল মনে হতে থাকে। ফলে অযথাই মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায় তাদের। অন্যের সম্পর্কে আলোচনা-সমালোচনা, গীবত, পরদিন্দা, মিথ্যা, ভ্রান্ত কথা, উদ্ভোট বাক্য ব্যবহার করা, মিলেমিশে না থাকার প্রভাব, হিংসাত্নক মনোভাব, ভারতীয় সিরিয়ালের দেখা দেখি একের কাছে অন্যের সমালোচনা করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে কতিপয় পরিবার ও সমাজে। বান্ধবীদের কাছে, বোনদের কাছে কিংবা অন্য কারো কাছে সমালোচনা করে আনন্দ পাচ্ছে কতিপয় শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত নারীরা। কে কী পোশাক পরছে,
কার ফ্ল্যাট অাছে, বাড়ি আছে, কার কতটুকু সম্পত্তি আছে, কার গাড়ি আছে, কার সন্তান আছে কার নেই, কার সন্তান লেখাপড়ায় ভালো, কার সন্তান দামী স্কুলে পড়ছে, কে বেশি দেখতে সুন্দর, কার অর্থ বেশি, কার জামা পোষাক কত বেশি দামী, কে বেশি স্ম্যার্ট, কে বেশি ভালো পজিশনে, কার স্বামীর আয় বেশি, কে কত দামী ব্র্যান্ডের পন্য ব্যবহার করে ইত্যাদি অনধিকার চর্চার অভ্যাস বাড়ছে।
ভারতীয় সংস্কৃতির বিরূপ প্রভাব
আমাদের দেশের বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিন, পূজা, ঈদ, সম্পর্ক সব কিছুতেই পড়েছে ভারতীয় সিরিয়ালের প্রভাব। হিন্দি সিরিয়ালের মতো করে অনেক বেশি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান, ষ্ট্যাইজ, লাইটিং, নাচ গান করা কিংবা ভারতীয় প্রথা অনুসরণ করার কারণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নিজস্ব দেশীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য।
অতিরিক্ত সাজ, ভারতীয় বিভিন্ন রকম পোষাক ও মেকআপ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া, ভারতীয় সিরিয়ালের নায়িকারা কড়া মেকআপ করে ঠোঁঠে গাঢ় লিপষ্টিক দিয়ে রাতে ঘুমাতে যায়, ঘুম থেকে ওঠেই, শপিং চলে যায়। এমনকি গোসল করে আসার পরেও মেকআপ করা থাকে। আর তাই সিরিয়াল আসক্ত নারীদের মধ্যেও অতিরিক্ত মেকআপ করা ও সিরিয়ালের নায়িকাদের মত দামী দামী সাজ পোশাক পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করার মত বৃদ্ধি পেয়েছে। লোক দেখানো কাজ করা কার কত দামী শাড়ি, থ্রি-পিস আছে, সিরিয়ালের নায়িকাদের স্টাইলের শাড়ি, গলার হার, গহনা ইত্যাদি সিরিয়ালের ভক্ত নারীদের ধ্যান-জ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে। কার চাইতে কে বেশি খরচ করে এসব কিনতে পারবে ও বান্ধবীদেরকে দেখাতে পারবে না নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা হয় নিজেদের মধ্যে। অসুস্থ এই প্রতিযোগিতায় যারা হেরে যায় তাদেরকে কটাক্ষ করতেও দ্বিধা করেন না অনেকে। এইসব চাওয়া পাওয়া নিয়ে সংসারে অশিক্ষিত কতিপয় পরিবারিক সুশিক্ষা বঞ্চিত স্বামী স্ত্রী’দের মাঝে অশান্তি হচ্ছে অবিরত। জীবনটাকে হিন্দি সিরিয়ালের মত ভাবতে গিয়েই যৌথ পরিবার, স্বামী স্ত্রী সন্তান,সমাজ ব্যবস্তা বিলুপ্তির পথে।ভারতীয় সিরিয়ালে অহরহই যে বিষয়টি দেখাচ্ছে তা হলো পরকীয়া।প্রতিটি সিরিয়ালেই পরকীয়া হলো ঘটনার একটি মূল উপাদান।নৈতিকতা বিরোধী এই সম্পর্ক অতিরিক্ত দেখার কারণে বেশ স্বাভাবিক মনে হচ্ছে গৃহিণীদের কাছে।তাই একটু সুযোগ পেলেই পরকীয়ায় লিপ্ত হচ্ছে অনেক নারী বা পুরুষ। এমনকি অনৈতিক শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে অনেকে। যা ইসলামীক ভাবে হারাম,এবং নৈতিকভাবেও চরম নোংরামীর বহিঃপ্রকাশ।এইসবের কারনে সমাজে এখন ডিভোর্স, ধর্ষণ সহ নানাবিধ নারী নির্যাতন সংক্রান্ত অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া অনেক মেয়েরা ও কিছু সংখ্যক ছেলেরাও সিরিয়ালে আসক্ত। প্রতিদিন পড়াশোনার মূল সময়টি তারা নষ্ট করে এসব সিরিয়াল দেখে।তাদের মা, খালা, নানি, দাদিরাও সেই সময়ে বসে সিরিয়াল দেখে বলে সন্তানদেরকে নিষেধ করতে পারেন না।ফলে তাদের পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কম বয়সেই ঝরে পড়ছে পড়াশোনা থেকে।অার হিন্দি সিরিয়াল গুলি দেখে তারা শিখছে সব নোংরামী যা আমাদের সমাজ ব্যবস্তার সাথে কোন ভাবেই গ্রহনযোগ্য না।
জ্ঞ্যান, নির্ভর শিক্ষিত পরিবার সন্তানদের এই সব হিন্দি সিরিয়ালের কুফল সম্পর্কে সন্তানদের বুঝাতে সক্ষম হলেও দেশের অধিকাংশ অর্ধ শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত, মূর্খ পরিবার গুলি এইসব সিরিয়ালের প্রতি চরম আসক্তি। যার কুফল সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে বিরাজ করে। সঠিক শিক্ষা,সুষ্ট পরিবেশ একটি আদর্শ পরিবার, সমাজ গঠনে মূল ভিত্তি।

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

পাঠক প্রিয়