চট্টবাণী : সাতক্ষীরা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় কর্মরত ১০টি এনজিও ‘ ঘূর্ণিঝড় আম্পান এবং পরবর্তী মৌসুমের ফসল ও মৎস্য সম্পদ রক্ষায় উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ নির্মাণ জরুরি’ শীর্ষক একটি অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে।
উপকূল ভিত্তিক এনজিও কোস্টের সহযোগিতায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন প্রগতি (সাতক্ষীরা)-এর আশেক এলাহী, উদয়ন বাংলাদেশ (বাগেরহাট)-এর শেখ আসাদ, পিজিইউস (পিরোজপুর)-এর জিয়াউল হাসান, সিআরইউপিডিএ (বরগুনা)-এর জিয়াউদ্দিন হিমু, সংগ্রাম (বরগুনা)-এর মাসুম চৌধুরী, কুতুবদিয়া উপজেলা প্রেস ক্লাবের এস কে লিটন কুতুবী, দ্বীপ উন্নয়ন সংস্থা (হাতিয়া)-এর রফিকুল আলম, সিএসআরএল থেকে প্রদীপ কে রায় এবং জিয়াউল হক মুক্তা, ডিজাস্টার ফোরাম’র গওহর নইম ওয়ারা, এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়াম্যান ড. আইনুন নিশাত। সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন কোস্ট ট্রাস্টের রেজাউল করিম চৌধুরী।
সংবাদ সম্মেলনে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ফলে উপকূলীয় এলাকার ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তুলে ধরে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কোস্টের সৈয়দ আমিনুল হক। তিনি উল্লেখ করেন, সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলা দুটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। দুই লক্ষ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ৩৪০ কোটি টাকার চিংড়ি, ১৪০ কোটি টাকার প্রাণিসম্পদ এবং ১৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়েছে। তিনি তিনটি জরুরি সুপারিশ তুলে ধরেন, (১) এই বর্ষায় ফসলের ক্ষতি রুখতে বেড়িবাঁধ মেরামত করার জন্য প্রায় ৪০০ কোটি জরুরি বরাদ্দ প্রয়োজন, (২) স্থানীয় সরকারকে এই জরুরি কাজ করার জন্য নিয়োগ দেওয়া উচিত, পানি উন্নয়ন বোর্ডে এক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে পারে এবং (৩) বাঁধের স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্থানীয় সরকারকে দেওয়া উচিত।
সাতক্ষীরার আশেক এলাহী স্থানীয় সরকারের উদ্যোগে জনসাধারণ কিভাবে তার অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় বেড়িবাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেছে তার বিবরণ তুলে ধরেন। বাগেরহাটের শেখ আসাদ বাগেরহাট অঞ্চলের পর্যাপ্ত ড্রেনেজ সুবিধার অভাবের কারণে কিভাবে লবণাক্ত পানি জীবিকার উপর সমস্যা তৈরি করছে এবং কিভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ড, স্থানীয় প্রশাসন তাদের ঠিকাদার এবং উপ-ঠিকাদার ব্যবস্থার কারণে সময়মতো বাঁধ নির্মাণে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে তার একটি বিবরণ তুলে ধরেন। হাতিয়ার রফিকুল আলম, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় যার ৭০ বছরেরও বেশি অভিজ্ঞতা আছে, তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় সংকেত ব্যবস্থাটি এখনও ঔপনিবেশিক আমলের মতো রয়ে গেছে, যা বন্দর রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছে, মানুষকে রক্ষা করার জন্য এটি পর্যাপ্ত নয়।
কুতুবদিয়া উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এস,কে,লিটন কুতুবী বলেন, পাউবোর ৭১ পোল্ডারের কুতুবদিয়া দ্বীপ রক্ষার ৪০কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ১৪ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। তন্মধ্যে ৫ কিলোমিটার বাঁধ ভাঙ্গা থাকায় জোয়ারের সময় নোনা জল লোকালয়ে চলে আসে। এতে ভিটিবাড়ি পুকুর প্রতিনিয়তই প্লাবিত হচ্ছে। এ ছাড়াও বাঁেধর উচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন উটেছে। বর্তমান বাঁধের চেয়ে তিন মিটার উচ্চতা বৃদ্ধি করলে বাঁধ টপকিয়ে জোয়ার লোকালয়ে ডুকতে পারবে না। আশ্রয় কেন্দ্রের অবস্থা নাজুক। ১৯৯১ সনের ঘূর্ণিঝড়ের পর নির্মিত আশ্রয় কেন্দ্রগুলো নির্মানের পর আর মেরামত বা সংস্কার করা হয়নি। তারপরও নেই পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র। সব মিলিয়ে কুতুবদিয়া দ্বীপের মানুষ মারাত্নক ঝুঁকিতে।
সিএসআরএল’র জিয়াউল হক মুক্তা উল্লেখ করেন, আইলার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের পরেও পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে সময় মতো বেড়িবাঁধ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে স্বতঃস্ফূর্ত গণউদ্যোগের উল্লেখ করেন, যারা স্বল্পমেয়াদে বেড়িবাঁধ মেরামত ও নির্মাণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। দুর্যোগ ফোরামের নইম গওহর ওয়ারা ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার উদাহরণ দিয়ে বলেন, সাধারণ মানুষ এবং এনজিওর সদস্যরা এখনও বেড়িবাঁধ টিকিয়ে রেখেছেন। তিনি আবাসন সুবিধাসহ ঘুর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের সুপারিশ করেন, যেখানে একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে মোটামৃুটি ৩৫ টি পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থা রাখা যায়। কলাপাড়ায় এই ধরনের উদাহরণ আছে। ড. আইনুন নিশাত আবহাওয়া অধিদপ্তরকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বা দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিয়ে আসার সুপারিশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন, ঘুর্ণিঝড় ব্যবস্থাপনায় বর্তমান সরকারের উদ্যোগ বেশিরভাগ সময়ই ‘ত্রাণ ভিত্তিক’, অথচ এটিকে হতে হবে ‘দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ভিত্তিক’।
কোস্টের রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতো সরকাাির প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করতে হবে এবং বেড়িবাঁধের মালিকানা জনগণকে দিতে হবে। তিনি আরও বলে, আগের মতো বিদেশী সাহায্যের উপর নির্ভর না করে, দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য আমাদের নিজস্ব সম্পদ নিয়েই পরিকল্পনা করতে হবে।