সুঁই সুতোয় স্বপ্ন বুনন
সংগ্রামী আছিয়া খাতুনের বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প
ফারুকুল ইসলাস/ এম মনির চৌধুরী রানা:আমাদের সমাজের প্রত্যেকটা মানুষের গল্পগুলো আলাদা। কেউ অর্থ বিত্ত দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। আবার কেউ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে নিজেকে সফলতার সর্বোচ্চ চূড়ায় অধিষ্ঠিত করেছেন।
আজ তেমন একজন সংগ্রামী নারীর গল্প পাঠকের সামনে তুলে ধরছি। যিনি সুঁই সুতোর ফোঁড়নে যে স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন, আজ তাঁর মেধা আর যোগ্যতা দিয়ে জীবনে সফলতার শিখরে আরোহণ করে সেই স্বপ্নপূরণ করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন গ্রামের জনপ্রিয় শিক্ষক মো. আবদুল মান্নানের পাঁচ সন্তানের মধ্যে ছোট সন্তান আছিয়া খাতুন। বাবা কাঞ্চন ভারত চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হওয়ার সুবাদে স্কুল ক্যাম্পাসের কোয়ার্টারেই বড় হতে থাকেন আছিয়া।
কাঞ্চন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে ভর্তি হন হাজী রফিজুদ্দীন ভূঁইয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। মেধাবী আছিয়ার শিক্ষা জীবনটা কাটছিল বেশ। ১৯৯৪ সালের ঘটনা- অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা চলাকালীন একদিন তাঁর বাবা মো. আবদুল মান্নান খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বুকে প্রচ- ব্যথা অনুভব করায় স্থানীয় ডাক্তাররা ঢাকায় নিয়ে যেতে বললেন। হার্টের রোগী হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে অনেক কষ্টে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় আছিয়ার বাবাকে। হাসপাতালে ভর্তির দু’দিন পর আছিয়ার বিজ্ঞান বিষয়ের পরীক্ষা চলছিল।
একই শ্রেণিতে অধ্যয়নরত আরেক বোন মাহমুদা খাতুনের পাশাপাশি বসে পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর খাতায় লেখায় মগ্ন আছিয়া। হঠাৎ বাইরে মাইকিং হচ্ছিল কাঞ্চন ভারত চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুল মান্নান ইন্তেকাল করেছেন।
কান আলগা করে শোনার চেষ্টা করলেন দুইবোন। যা শুনলেন তা নিজের কানকেও বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। বাবা নেই! এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। বাবার মৃত্যুর পর সংসারে নেমে এলো অমানিশা।
সংসার আর পাঁচ ছেলে মেয়ের খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল হাজী রফিজুদ্দীন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা আনোয়ারা বেগমের। তিন হাজার টাকা মাইনে দিয়ে সবকিছু সামলানো আনোয়ারা বেগমের কাছে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লো।
তাছাড়া যেসব শুভাকাক্ষী আছিয়াদের পাশে থেকে শিক্ষার খরচ বহন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারাও এক সময় সহযোগিতার হাত গুঁটিয়ে নেন। সন্তানদের লেখাপড়া আর সংসারটাকে টেনে নিতে মা আনোয়ারা বেগম নেমে পড়লেন আরেকটা যুদ্ধে।
সেলাইয়ের কাজটা ভালো জানতেন বলেই ঘরে শুরু করলেন সুঁই-সুতোর কারবার। আর এই কাজে সহযোগী হলেন তিন কন্যা মাসুদা, মাহমুদা এবং আছিয়া। স্কুলে শিক্ষাদানের পাশাপাশি তিন মেয়েকে নিয়ে জামা সেলাইয়ের কাজটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
ঈদ এলে কাজের ব্যস্ততা বেড়ে যেতো। রমজানের পুরো মাস জুড়ে আছিয়ার পরিবারে চলতো অর্ডারের জামা সেলাইয়ের কাজ। ঈদের দিন আছিয়াদের তৈরি পোশাক পরে মানুষ আনন্দ করলেও, নতুন পোশাক পরার সৌভাগ্য তাঁদের হতো না। তবে এতে একটুও মনে কষ্ট ছিলো না।
কারণ তাঁদের শিক্ষক পিতা তো মাত্র দুটো পাঞ্জাবি দিয়ে ১৮টা বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। নতুন জামা পরার চেয়ে নিজেদের স্বপ্ন ছোঁয়াই ছিলো আছিয়াদের আসল লক্ষ্য। ১৯৯৭ সালে বাবার প্রতিষ্ঠিত হাজী রফিজুদ্দীন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্টার মার্কস নিয়ে এসএসসি পাশ করেন দুইবোন মাহমুদা আর আছিয়া।
ঢাকার হলিক্রস আর ভিকারুন্নেসা কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েও পড়তে পারেননি। পরবর্তীতে মেঝবোন মাসুদা তাঁদের ভর্তি করালেন বদরুন্নেসা কলেজে। মেঝবোন টিউশনির টাকা দিয়ে তাঁদের পড়ালেখার খরচ চালানোর আশ্বাস দিলেন।
এদিকে পিতার যেটুকু জায়গা জমি ছিলো তাও বেদখল হয়ে গেলো। মৃত্যুর পূর্বে আবদুল মান্নান মানুষের কাছে যা টাকা পয়সা পেতেন তাঁর মৃত্যুর পর তা আর কেউ ফেরৎ দেননি। পৈত্রিক জায়গা দখল হয়ে যাওয়ায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর বাবার স্কুল থেকে পাওয়া কোয়ার্টারেই শেষ মাথা গোঁজার ঠাঁই হলো।
তাতেও বিপত্তি ঘটলো! আবদুল মান্নানের মৃত্যুর পর নতুন প্রধান শিক্ষকের জন্য কোয়ার্টারটি প্রয়োজন হলো। ভিটেমাটিহীন পরিবারটা এ অবস্থায় কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবে? ভাড়া বাসায় থাকার সার্মথ্যও নেই। শেষে স্কুল কমিটিকে অনুরোধ করে ছোট দুই মেয়ের এসএসসি পর্যন্ত কোয়ার্টারে বসবাসের অনুমতি নিলেন আনোয়ারা বেগম।
এদিকে, বদরুন্নেসা কলেজে ভর্তি হবার পরও অনিশ্চিয়তা পিছু ছাড়ে না। কারণ ঢাকায় থেকে পড়ালেখা করতে হলে কোন বাসা বা হোস্টেলে তো উঠতে হবে। তাছাড়া নিজের খালা-মামার বাসায়ও থাকতে নারাজ আছিয়া আর মাহমুদা।
শেষে বদরুন্নেসা কলেজকে বিদায় দিয়ে দুইবোন ফিরে এলেন নিজ গ্রামে। ভর্তি হলেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত ছমিউদ্দিন কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাশ করলেন স্টার মার্কস নিয়ে। এবার স্বপ্ন মেডিকেল অথবা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার। সে মোতাবেক ভর্তি হলেন রেটিনা আর পজিট্রন কোচিংয়ে।
ঢাকায় কোচিং করতে গিয়ে অর্জন করেছেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কখনো পথ হারানো, কখনো না খেয়ে কোচিং করা, রিক্সা ভাড়া বাঁচানোর জন্য পায়ে হেঁটে কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া। এরপরও দমে যাননি আছিয়া। এতকিছুর পরও মেডিকেলে চান্স পেলেন না আছিয়া খাতুন। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য নতুন মিশন শুরু করলেন।
সে মোতাবেক ফরমও কিনলেন। কিন্তু তাও একটি মাত্র ফরম। কারণ দুই ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার জন্য দুটো ফরম কেনার মতো সার্মথ্য আছিয়ার ছিলো না। এক ফরমেই ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয় পেলেন এপ্লাইড কেমিস্ট্রি। বোন মাহমুদা পেলেন প্রাণীবিদ্যা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে উঠলেন বিবাহিত বোন মাসুদার ঢাকার বাসায়। পরবর্তীতে ছাত্রাবাসে থাকার অনুমতি মিললো কয়েকমাস পর। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরও সংগ্রাম শেষ হয়নি।
ডাক্তার ভাই আর পরিবার থেকে যেটুকু সহায়তা পেতেন তাতেও হতো না। তাই কখনো মূল বই কিনতে পারেননি। তাঁদের নির্ভর করতে হতো শাহবাগের ফটোকপিয়ারের দোকানের উপর। রোকেয়া হল থেকে কার্জন হলে যেতেন পায়ে হেঁটে।
এতে করে পাঁচ টাকা সাশ্রয় হতো। আর পাঁচ টাকা দিয়ে সেসময় বিশ