২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | শুক্রবার
১৩ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
১৭ই শাওয়াল, ১৪৪৫ হিজরি

হাশেম খান চেতনাঋদ্ধ একজন সৃজনশীল মানুষ : এম নজরুল ইসলাম

চিটাগাং মেইল: বাংলাদেশের শিল্পাঙ্গনে অন্যতম দিকপাল তিনি। রং-তুলিতেই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি তার নিজের পরিচয়। রেখেছেন সৃজনশীলতার অনন্য স্বাক্ষর। শিল্পকলায় নিমগ্ন শিল্পী হাশেম খান ৭৮ পূর্ণ করে আজ ১৬ এপ্রিল পা দিয়েছেন ৭৯-তে। সৃষ্টিশীল শিল্পী হাশেম খান তার সৃজনশীল কর্মপ্রবাহে সমৃদ্ধ করে চলেছেন চারুকলা।

১৯৪২ সালের এই দিনে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের সেকদী গ্রামে এক সভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন কুমিল্লা জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইউসুফ খান ও মা (গৃহিণী ) নূরেন্নেসা খানম-এর ১৪টি সন্তানের মধ্যে তিনি ৬ষ্ঠ। ১৯৬৯ সালে কুমিল্লার ব্রাক্ষণবাড়িয়ার পারভীন হককে বিয়ে করেন তিনি। এ দম্পতি কনক খান ও শান্তনু খান নামে এক কন্যা এবং এক পুত্র সন্তানের জনক-জননী। বাংলাদেশের চিত্রকলায় শিল্পী হাশেম খানের নিজস্বতা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই।

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খ্যাতিমান এই শিল্পী দীর্ঘ ৬২ বছর যাবত শিল্পচর্চায় ও সংকৃতি বিকাশে নিয়োজিত। ১৯৬৩ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত চারুকলা অনুষদের সফল শিক্ষক ও তার ছাত্রছাত্রীরাই বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে শিল্পচর্চায় সুনাম অর্জন করে চলেছেন।

দেশের চারুকলা বিকাশের আন্দোলন, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে এবং প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশ সৃষ্টিতে তিনি নিবেদিতপ্রাণ।

তরুণ বয়সে তিনি কচি-কাঁচার মেলার মাধ্যমে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের উপদেশ ও সহযোগিতায় শিশু চিত্রকলাকে সংস্কৃতিচর্চার বিষয় হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করেন। বাংলাদেশে শিশু শিক্ষা ও শিশু চিত্রকলার ক্ষেত্রে শিল্পী হাশেম খানেরই অগ্রণী ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রয়েছে। শিশুচিত্রের সংস্কৃতি বাংলাদেশের সমাজে তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং এ বিষয়ে গরেষণা করেছেন।

শিশু পুস্তকে ছবি এঁকে শিশুপাঠকে শিশুদের কাছে আনন্দের বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন। এভাবে তিনি বাংলাদেশের জনগণ, যারা এখন ৬০/৬৫ বছর বয়সে তাদের স্কুল পাঠ্য বইয়ের চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশকে চিনিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ ও জীবনধারাকে চিনিয়েছেন। আজ শিশু চিত্রকলা বাংলাদেশে শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। তিনি এই ধারার পথিকৃৎ।

হাশেম খান ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। তিনি ষাটের দশকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও প্রগতিশীল রাজনীতির প্রায় সব পোস্টার, ফেস্টুন, ছবি, প্রচার পুস্তিকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন। ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তি সনদ ঐতিহাসিক ছয়-দফার লোগো, পতাকা নকশা, পোস্টার ও অন্যান্য শিল্পকর্ম করেছেন শিল্পী হাশেম খান। ছয়-দফা সর্বপ্রথম জনগণের সম্মুখে ঘোষণার জন্যে তৎকালীন হোটেল ইডেনের সামনে যে মঞ্চ তৈরি হয়েছিল তার ‘ব্যাকসিনে’ ছয়-দফার প্রতীকী নকশা দিয়ে সাজিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরে যে ঐতিহাসিক পোস্টার ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন?’ এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল- তা এঁকেছিলেন শিল্পী হাশেম খান।

বাংলাদেশের সংবিধান গ্রন্থটির শিল্পমান সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ১৯৭৩ সালের মে মাসে বঙ্গবন্ধু শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। শিল্পাচার্য তার প্রিয়ভাজন শিল্পী হাশেম খানকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। রুমে ঢুকতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আবেদিন ভাই আসুন।’ তারপর দু’জনে করমর্দন করলেন। শিল্পাচার্য তার প্রিয় ছাত্র হাশেম খানকে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধু মাঝখানে শিল্পাচার্যকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আবেদিন ভাই, আপনি বসুন, আমিই ওর পরিচয় দিচ্ছি। ও আমার ছয়-দফা’র মনোগ্রাম, নকশা, পোস্টার করেছিল। ছয়-দফা ঘোষণার জন্যে যে মঞ্চ তৈরি হয়েছিল তার ব্যাকসিনটা ও এত সুন্দরভাবে করেছিল আমার এখনো সব মনে আছে। ছয় রং, ছয়টি গঠন ও আকৃতি ইত্যাদি দিয়ে সেদিন ছয়-দফা’র যে ব্যাখ্যা দিয়েছিল আমি আগে ভাবতেই পারিনি আমার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা ও বাঙালিদের নায্য অধিকারসহ নকশা, ছবি দিয়ে ছয়-দফা’র এত চমৎকার ব্যাখ্যা হয়। বাংলার মানুষের জীবন যাপন এবং চিন্তা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হয় ছয় ঋতু দিয়ে। আমার রাজনৈতিক ছয়-দফা এবং বাংলার মানুষের জীবনের ছয় ঋতুকে সে একীভূত করে ছয়-দফা’র অপূর্ব নকশা করেছিল। আবেদিন ভাই, সংবিধান গ্রন্থে ছবি আঁকার জন্যে আপনি ঠিক লোককেই পছন্দ করেছেন।’

বাংলাদেশের ‘সংবিধান গ্রন্থের’ প্রতিপৃষ্ঠায় চারদিক জুড়ে রয়েছে নকশা এবং ভেতরে লেখা। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের তত্ত্বাবধানে প্রধান শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন শিল্পী হাশেম খান। নকশা তৈরি করেছেন জুনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী ও আবুল বারক আলভী। লিপিকার ছিলেন, আব্দুর রউফ।

বঙ্গবন্ধুর জীবনভিত্তিক প্রায় ৩০০ ছবির একটি অ্যালবামের তিনি নির্বাহী সম্পাদক। ওই অ্যালবামের সম্পাদকমণ্ডন্ডলীর সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। যা ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়। ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিশু গ্রন্থমালা’ সিরিজের সম্পাদকীয় বোর্ডের তিনি সভাপতি। এই সিরিজে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে বই ও ছবির অ্যালবাম মিলে মোট ২৫টি ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এ বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ওই ২৫টি বই ও ছবির অ্যালবামের নতুন সংস্করণ ১৭ মার্চ পুনরায় প্রকাশিত হয়েছে।

ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রের তিনটি অ্যালবামের ও বাংলাদেশ ব্যাংকের শিল্পকলা সংগ্রহ অ্যালবামের তিনি যুগ্ম-সম্পাদক ও টাকা জাদুঘর বাস্তবায়ন কমিটির চেয়ারম্যান।

ঢাকা নগর জাদুঘরের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত স্বাধীনতা স্তম্ভের জুরি বোর্ড ও বাস্তবায়ন বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। শিল্পী হাশেম খান ছিলেন শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা, জাতীয় নাট্যশালা এবং জাতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্রের বাস্তবায়নের তিন সদস্য বিশিষ্ট স্টিয়ারিং কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যান। তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যানও ছিলেন।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জাতীয় কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা। ১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিল্পী হাশেম খান এখন প্রতিষ্ঠানটির কর্মপরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ের অলঙ্করণ ছাড়াও তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের চারুকলা ও ললিতকলা বিষয়ক পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করেছেন। ১৯৬১ সাল থেকে এ যাবত দেশে ও আন্তর্জাতিক অসংখ্য প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খান। চিত্রকলা, সংস্কৃতি ও শিশু বিষয়ক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠিত বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।

উল্লেখযোগ্য দেশগুলি হলো: জাপান, চীন, ভারত, নেপাল, জার্মানি, বুলগেরিয়া ও তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়া। দেশে-বিদেশের বহু প্রশিক্ষণ কর্মশালায় নেতৃত্বও দিয়েছেন খ্যাতিমান এই চিত্রশিল্পী।
শিল্পকর্মে অসামান্য অবদানের জন্যে তিনি ১৯৯২ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ২০১১ সালে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি দেশি এবং আন্তর্জাতিক বহু পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। বইয়ের প্রচ্ছদের জন্য ১৬ বার জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র কর্তৃক পুরস্কৃত হয়েছেন। ২০০৭ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলো মনোনীত করে। ৩ বার অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।

তিনি একজন সুলেখকও। এ-যাবত তার প্রকাশিত গ্রন্থ ২০টি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে কয়েকটি হলো: গুলিবিদ্ধ ’৭১, স্বাধীনতা ও জরিনারা, চারুকলা পাঠ, নিরাবরণ কন্যার গল্প অল্প, জয়নুল গল্প ও জয়নুলের সারাজীবন, শিশু কিশোর উপন্যাস কটিক, মধুবক ও মায়ের বাক্স।

পাবলো পিকাসো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, ভিনসেন্ট ভ্যান গগ প্রমুখ কিংবদন্তি চিত্রশিল্পীর জীবন ইতিহাস বলে, শিল্পীরা হলেন তেমন চেতনাঋদ্ধ মানুষ যারা আঁধারেও স্বপ্ন দেখেন, মুক্তির কথা ভাবেন। সেই জন্যেই ভিতরের অর্গল খুলে সৃজন উল্লাসে মগ্ন হন। আমাদের শিল্পী হাশেম খানও এর ব্যতিক্রম নন। তাঁর তুলিতে মানুষ, মানুষের অধিকার, প্রকৃতি এবং দেশের কথা উঠে আসে।
বঙ্গবন্ধুপ্রেমিক এই প্রত্যয়দীপ্ত মানুষটি বঙ্গবন্ধুহীন দেশের অনাথবোধ, নিঃসঙ্গতা থেকে কষ্ট আর আবেগ নিয়ে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য ছবি আঁকছেন।

বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে ২৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৯ ফুট উঁচু বিশাল একটি ক্যানভাস শুরু করেছেন। একই সঙ্গে আঁকছেন আরো কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা বিষয়ক ক্যানভাস-যেমন, শেখ মুজিবের ছয় দফা ঘোষণা, সোনার বাংলা শ্মশান কেন?, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু, সবুজ বিপ্লব ১৯৭২ এবং বাকশাল ১৯৭৫ ইত্যাদি।

তিনি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার দ্রুত শেষ করে সর্বোচ্চ শান্তি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদ এবং সোয়া চার লাখেরও অধিক ধর্ষিত নারীর পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে জাতিকে মুক্ত করার লড়াইয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
আজ সারা বিশ্বসহ বাংলাদেশও করোনা ভাইরাসের মতো ধ্বংসাত্মক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। এই সমস্যা মোকাবিলা করার সঙ্গেই শিল্পী হাশেম খানের ৭৯তম জন্মদিনে আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন। শুভ জন্মদিন হাশেম ভাই।

লেখক: সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং
অস্ট্রিয়া প্রবাসী মানবাধিকারকর্মী, লেখক ও সাংবাদিক।

Share on facebook
Facebook
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on twitter
Twitter
Share on linkedin
LinkedIn

সর্বশেষ খবর

পাঠক প্রিয়